করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রাণ কোন পথে

করোনাভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বলে, শহরের পাড়া-মহল্লায়ও এটির আগ্রাসন লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রথম দিকে কিছু হটস্পটে এটিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তাই এখন সবাই ঝুঁকিতে পড়েছি। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো স্বীকৃত চিকিৎসাপদ্ধতি নেই, নেই কোনো ভ্যাকসিন। বিশেষজ্ঞরা বলতে পারছেন না কখন এটি পাওয়া যাবে। এই মুহূর্তে তাই আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। এইডস ও সা‍র্স‍‍ ভাইরাসের টিকাই এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই আমাদের এর সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে; করোনাভাইরাস ‘রেসিলিয়্যান্ট’ বা সহনীয় হয়ে উঠতে হবে। প্রকৃতিতে নানা ধরনের অজস্র ভাইরাস বিরাজমান, যেগুলোর সঙ্গে মানুষ সহাবস্থান করতে পেরেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে যেহেতু সুস্থ মানুষও সংক্রমিত হয়, সেহেতু এই অদৃশ্য ভয়ানক সংক্রামক শত্রুর প্রতি সহনীয় হয়ে উঠতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।

একটি গ্রাম বা মহল্লায় একজন ব্যক্তিও যদি সংক্রমিত হয়, তাহলে পুরো গ্রামবাসীর সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। গ্রামের সবচেয়ে প্রান্তিক ব্যক্তিটির নিরাপত্তার ওপর সবার নিরাপত্তা নির্ভরশীল। অতএব নিজের এবং আপনজনের সুরক্ষা দিতে হলে সবারই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তাই করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সবার অংশগ্রহণ এবং একটি সামাজিক আন্দোলন। এর স্লোগান হতে পারে:

আসুন, সবাই মিলে শপথ করি,

স্থানীয়ভাবে করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করি।

 আমরা দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে সম্প্রতি ‘করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম’ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ রকমই একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম সৃষ্টির জন্য মোটাদাগে তিনটি কাজ করে চলেছে আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা। প্রথমত, সচেতনতা সৃষ্টি, বিশেষত হাত ধোয়া, গ্লাভস পরা, মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, যার লক্ষ্য হলো মানুষের অভ্যাস ও আচরণে পরিবর্তন আনা এবং নিজের সুরক্ষার দায়িত্ব নিজে নেওয়া। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রচারিত ভুল তথ্য বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। আমাদের ‘গ্রাম উন্নয়ন দল’ ও ‘গণগবেষণা সমিতি’র প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতীরা লিফলেট ব্যবহার করে এবং স্বল্প পরিসরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে এ সচেতনতা সৃষ্টি করছে। এর উদ্দেশ্য শুধু তথ্য দিয়ে মানুষকে ক্ষমতায়িত করা নয়, বরং তাদের বোধে আনা, যাতে তারা তা চর্চা করে। এই কাজে গ্রামের মাতবর, ইমাম, পুরোহিত, বিশেষত তরুণ ও নারী এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের যুক্ত করা আবশ্যক। এ কথা জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন, প্রত্যেক ব্যক্তি দায়িত্বশীল না হলে এবং নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত না করলে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দিয়ে বিশেষ লাভ হবে না। এ জন্য অবশ্যই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে আচরণ পরিবর্তন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, চিহ্নিত, পৃথক ও সহায়তা করা: ভাইরাসের লক্ষণ দৃশ্যমান—এমন ব্যক্তিদের পৃথক থাকতে এবং স্বাস্থ্যসেবা পেতে স্বেচ্ছাব্রতীরা সহায়তা করছে। একই সঙ্গে তারা যাতে নিগ্রহের শিকার না হয়, তা নিশ্চিতে সচেতনতা তৈরি করে চলেছে। এ ছাড়া এমন পরিস্থিতিতে বেড়ে যাওয়া নারী-শিশু নির্যাতন ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নজর রাখছে।

 তৃতীয়ত, তালিকাভুক্ত ও সহায়তা করা: এমন ব্যক্তি ও পরিবার, যারা জীবিকাহারা ও খাদ্যসংকটে আছে, তাদের তালিকা প্রণয়ন করছে স্বেচ্ছাব্রতীরা। তালিকায় অগ্রাধিকার পায় নারীপ্রধান পরিবার এবং শিশু ও প্রতিবন্ধী সদস্য রয়েছে—এমন পরিবার। এসব পরিবার যাতে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আসতে পারে, স্বেচ্ছাব্রতীরা সে ব্যাপারে তাদের সহায়তা করে। একই সঙ্গে তারা ‘কমিউনিটি ফিলান্থ্রপি’র মাধ্যমে অর্থ, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে সাময়িক সহায়তার জন্য তাদের মধ্যে তা বিতরণ করে। তবে মনে রাখতে হবে, এই মহাবিপর্যয়ের সময়ে জরুরি সহায়তা প্রদান সরকারের দায়িত্ব এবং তা পাওয়া মানুষের অধিকার।

স্বেচ্ছাব্রতীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এবং পুরো সমাজের সম্পৃক্ততায় পরিচালিত এই কার্যক্রম এখন প্রায় ১ হাজার ৪০০ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েক সপ্তাহে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াও আড়াই কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের খাদ্য, অন্যান্য সামগ্রী ও অর্থ সংগ্রহ করে বিপন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করেছে। সর্বোপরি এর মাধ্যমে সমাজের শুভ শক্তিগুলো একত্র হওয়া শুরু করেছে। স্থানীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করলেও এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো সচেতনতা, সচেতনতা এবং সচেতনতা সৃষ্টি, যাতে মানুষের মধ্যে আমার স্বাস্থ্য, আমার দায়িত্ব—এমন মানসিকতা তৈরি হয় এবং তাদের আচরণ বদলায়।

গত ১৯ মে আমরা এ উদ্যোগ নিয়ে একটি আলোচনা সভা করেছিলাম, যাতে আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্থানীয় সরকারসচিব আবু আলম শহীদ খান, আইইসিডিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন, হেলথ অ্যান্ড হোপের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. তাজিন মুর্শিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়াদুল করিম, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, রাজনীতিবিদ রুহিন হোসেন প্রিন্স, ব্রিটিশ কাউন্সিলের ড. শাহনাজ করিম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রায় সবাই এটিকে একটি সৃজনশীল উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাননীয় মন্ত্রীও উদ্যোগটি সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ প্রদর্শন করেন এবং একটি লিখিত প্রস্তাব চান।

সাবেক স্থানীয় সরকারসচিব আবু আলম শহীদ খান উদ্যোগটির প্রশংসা করে বলেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে কাজ করার ফলে তাদের সঙ্গে একটা সেতুবন্ধ তৈরি হচ্ছে। সরকারের সহায়তা জায়গামতো পৌঁছাচ্ছে। স্থানীয় ফিলান্থ্রপিক উদ্যোগকেও সরকারের ভূমিকার সম্পূরক বলে তিনি উল্লেখ করেন, কারণ সরকার সবকিছু ঠিকঠাকভাবে করলেও মাঝখানে কিছু মানুষ থেকে যাবে, যাদের কাছে সরকার পৌঁছাতে পারবে না। পরিকল্পনামন্ত্রীর মাধ্যমে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের কাছে তিনি এর বার্তা পৌঁছে দিতে চান এবং এই মডেলের অনুসরণে স্থানীয় সরকার, এনজিও এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যান্য গ্রাম, এমনকি শহরে করোনা মোকাবিলার পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে বলেন।

আইইসিডিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন মনে করেন, কোভিড-১৯-এর মহামারি আপনা থেকে নির্মূল হয়ে যাবে না। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এটির লাগাম টেনেছে আগ্রাসী ‘কন্টেইনমেন্ট’ বা নিয়ন্ত্রণ ও ‘মিটিগেশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে, শুধু তথাকথিত লকডাউনের মাধ্যমে নয়। তাঁর মতে, ‘করোনা রেসিলিয়্যান্ট গ্রাম’ একটি মডেল, যা শুধু গ্রামের জন্যই নয়, নগর ও শহরেও এটি বাস্তবায়নযোগ্য। এই মডেল সারা বাংলাদেশে ব্যবহৃত হলে এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্য দেশগুলোও আমাদের অনুসরণ করবে।

আমাদের এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ইতিমধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছে। দ্য ইকোনমিস্ট ও বিবিসি এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে। আশা করা যায় যে তারা এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।

আজ মানুষের জীবন রক্ষার্থে এবং করোনাভাইরাসের মতো অদৃশ্য শত্রুর বিস্তার রোধে গ্রামের সব মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে এবং নিজ গ্রামের দায়িত্ব নিতে হবে। যাঁরা গ্রামে বসবাস করছেন না, তাঁরাও গ্রামে অবস্থান করা স্বজনদের জীবন রক্ষার্থে এ কাজে ভূমিকা রাখতে পারেন। ১৯৭১ সালের মতো আজ আবারও ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার পালা। শুধু মুষ্টিমেয় স্বাস্থ্যকর্মী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটিকে প্রতিরোধ করা যাবে না, যদি না সত্যিই জনপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে। জনপ্রতিরোধের মাধ্যমে আমরা অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে জিততে পারি, যেমন পেরেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। যখন আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে, যার যা কিছু ছিল তা নিয়ে শত্রুর—পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর—মোকাবিলা করেছিল।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর