যে কারণে ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকল চীন

ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে সোমবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে সোমবার রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

সংঘাতটা হঠাৎ করে হয়েছে—এমনটা বলা যাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে একটা শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে। সেটিরই একটি অনিবার্য অবস্থা এটি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, একাধিক কারণে চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল, সংক্ষেপে এলএসি) পাশে সেনা জমায়েত করছে। সেই একাধিক কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ হলো তিব্বতকে পুরোপুরি কবজায় আনা এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা ঘেঁষে ভারতের স্থাপনা গড়ে তোলা ঠেকিয়ে দেওয়া। ফলস্বরূপ ৪৫ বছর পর এই প্রথম দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধল।

লেহ্ থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি বিমানসেনা ঘাঁটি (১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপ) পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করছে ভারত। কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত এই রাস্তা গেছে গালওয়ান উপত্যকা হয়ে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া এই রাস্তা নিয়েই আসলে চীনের মূল আপত্তি।

পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকুলা এবং প্যাংগং হ্রদের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে গত মে মাসে ভারতীয় ভূখণ্ডের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল চীনা সেনারা। তারা সেখানে প্রথমে তাঁবু গেড়েছিল। পরে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে এবং রাস্তা বানানো শুরু করে। তখন থেকেই সিকিম এবং লাদাখ এলাকায় দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। মে মাসেই প্যাংগং হ্রদের কাছে ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। তারপর থেকেই সীমান্তের বেশ কয়েকটি এলাকায় মুখোমুখি অবস্থানে ছিল দুই দেশের সেনারা। এরপর সোমবার রাতে গালওয়ান উপত্যকায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই যে মধ্যযুগীয় কায়দায় সংঘাত হয়েছে, তাতে ভারতের অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে। চীন তাদের সেনারা নিহত হয়েছে স্বীকার করলেও এখনো সংখ্যাটা বলেনি।

যে এলাকায় সংঘাত হয়েছে, সেটিকে চীন কখনোই তাদের এলাকা বলে দাবি করেনি। সোমবার সংঘাতের কয়েক ঘণ্টা আগে দুই পক্ষের কর্মকর্তাদের যে বৈঠক হয়েছিল সেখানেও তারা তেমনটা দাবি করেনি এবং সেখান থেকে তারা নিজেদের তাঁবু গুটিয়ে নেবে বলেও কথা দিয়েছিল। কিন্তু সংঘাতের পর মঙ্গলবার চীনের লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘গালওয়ান উপত্যকার সার্বভৌমত্ব সব সময়ই আমাদের’।

চীনের এই চর্চা নতুন কিছু নয়। এরা কোনো বিতর্কিত জায়গায় প্রথমে সামরিক উপস্থিতি ঘটায়, তারপর গোটা এলাকার মালিকানা দাবি করে বসে। লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের প্রকৃত সীমান্তরেখা ঘেঁষে কয়েক বছর ধরে দ্রুতগতিতে ভারত রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের অবকাঠামো গড়ে তুলছে। বিষয়টি চীনকে মহা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে এখানে বেশ কিছু সেতু নির্মাণ এবং ভারতের দারবুক-শাইয়োক-দৌলত বেগ ওল্ডি রোড (ডিএসডিবিও) বানানো নিয়ে আপত্তি আছে চীনের।

এর বাইরেও ভারতের ওপর চীনের খাপ্পা হওয়ার আরও কিছু কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো তিব্বত এবং বৌদ্ধদের ধর্মীয় গুরু দালাই লামা ইস্যু। চীনের কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন, বৌদ্ধদের পরবর্তী দালাই লামা কে হবেন, তা নিয়ে ভারতের মাথা ঘামানো উচিত নয়। বর্তমান দালাই লামা ভারতভিত্তিক। তিনি মূলত ভারতেই থাকেন এবং তিব্বতের স্বাধীনতাকামী প্রবাসী সরকারও ভারত থেকে পরিচালিত হয়। এটি চীনের জন্য অসুবিধার কারণ।

ভারতের ওপর চীনের চটে যাওয়ার আরেকটি কারণ কোভিড–১৯ সংক্রান্ত। করোনাভাইরাস চীন থেকে ছড়ানো এবং এই ভাইরাস মোকাবিলায় চীনের তৎপরতা নিয়ে চীনের ভেতরে ও বাইরে সমালোচনা হচ্ছে। ভাইরাসটি কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে তা অনুসন্ধানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে যে দেশগুলো চাপ দিয়ে আসছে, তার মধ্যে ভারতও আছে। সীমান্তের উত্তেজনার সঙ্গে মহামারি মোকাবিলার যোগসূত্র খোঁজাকে অনেকে অমূলক ভাবতে পারেন। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বিরুদ্ধে করোনা ইস্যুতে যে সমালোচনার ঝড় বইছে, তা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে এ ঘটনা সহায়ক হবে। নিজ অঞ্চলে চীন যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম, তা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে দেখানোও তার একটি বড় উদ্দেশ্য।

এ অবস্থায় চীনের আগ্রাসন রুখতে ভারতের সবাইকে এক হতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) সাবেক স্পেশাল সেক্রেটারি অমিতাভ মাথুরের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, সরকারকে এখন বিরোধীদের আস্থায় এনে সীমান্ত সংঘাতের বিষয়টিকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে মোকাবিলা করতে হবে।

হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
রেজাউল এইচ লস্কর: হিন্দুস্তান টাইমসের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডেস্কের প্রধান