'লিভিং ইগল'-এর বিদায়

ইংরেজিতে একটি বহুল পরিচিত কথা রয়েছে, ‘বার্থ ইজ দ্য হেরাল্ড অব ডেথ’, ‘জন্মগ্রহণ মৃত্যুর ইঙ্গিতমাত্র; যেটাকে আমাদের ধর্মে বলে, ‘প্রতিটি জীবন্ত জিনিসকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মানুষের মৃত্যু অবধারিত। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করলেও খুব কম মানুষই জীবন্ত থাকে তাদের জীবনের অনেক ভালো বা খুব খারাপ কর্মকাণ্ডের জন্য। আমাদের দেশেও এমন মানুষ রয়েছে, যদিও বিরল; যাদের মৃত্যু নিয়ে দেশের বাইরেও চর্চিত হয়েছে, বিভিন্ন দেশে শোক প্রকাশ করেছে। শুধু শীর্ষ রাজনীতিবিদসহ খুব কম হাতে গোনা মানুষের হতে পারে। তবে এমন মানুষ খুব বেশি নয়, যাঁদের নিজ কর্মক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঐতিহাসিক কারণে জীবদ্দশাতেই ‘লিভিং লিজেন্ডে’ পরিণত হয়েছেন। এমনই একজন মানুষ ছিলেন সৈনিক বিমানযোদ্ধা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম। সিতারা-ই-জুরাত (পাকিস্তান), হুসেম-ই-ইসতেকলাল (জর্ডান), এ নথ-ই সুজা (ইরাক)।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম হয়তো বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে বা প্রেক্ষাপটে খুব একটা পরিচিত বা জৌলুশপূর্ণ নাম নয় যে কারণে গত ১৪ জুন দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিরবে-নিভৃতে মৃত্যুবরণ করেন এই আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিক সামরিক, বিশেষ করে ১৯৬৫ পাকিস্তান-ভারত এবং ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের নায়ক। যাকে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী বিশ্বের সেরা ২২ জন বিমানবাহিনীর যোদ্ধা পাইলটদের (কমব্যাট ফাইটার) একজন জীবিত ঈগল ( লিভিং ঈগল) বলে উল্লেখ করেছে এবং তেমনিভাবেই ইতিহাসে রচিত থাকবে। ১৯৫৮ সালে বাঙালি এই যুবক তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী থেকে অতি কৃতিত্বের সঙ্গে বিমানযুদ্ধের কৌশল ট্রেনিং শেষ করেছিলেন। তাঁর কৃতিত্বে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ‘টপ গান’ আখ্যায় ভূষিত করেছিল।

আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ যতই প্রযুক্তিনির্ভর এবং পরোক্ষভাবে হোক না কেন, আকাশে জঙ্গিবিমান যুদ্ধ-ব্যক্তিগত সাহস বিচক্ষণতা এবং অস্ত্রের সঠিক সময়ের ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করে। এ যুদ্ধ এখনো ওয়ান-টু-ওয়ান মানে আমার আর তোমার মধ্যে যেমন মধ্যযুগে তলোয়ার যুদ্ধে হতো। ওই সময় তলোয়ার যুদ্ধে সাহস, শৌর্য, বীর্য এবং ত্বরিত তৎপরতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। আজও শুধু বিমানবাহিনীতে এ ধরনের যুদ্ধের অবকাশ রয়েছে, আছে এবং থাকবে। কাজেই একজন পাইলট, যিনি একাধারে যোদ্ধা, ফাইটার পাইলটের এসব গুণ অবশ্যই থাকতে হয়। সাইফুল আজম তিনটি দেশে দুটি যুদ্ধে তেমনই দেখিয়েছিলেন। বিশ্বের খুব কমই ফাইটার পাইলট ছিলেন, যাঁরা চারটি দেশের বিমানবাহিনীতে চাকরি ও তিনটি দেশের বিমানবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বাঙালি ফাইটার পাইলট যে কয়েকজন সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম; যিনি বারবার ভারতীয় বিমানঘাঁটি আক্রমণ এবং এমন আক্রমণের সময় তাঁর বিমান এফ-৮৬ আক্রান্ত হলে তিনি ভারতীয় ফোল্যান্ড নেট বিমান একক আকাশযুদ্ধে ভূপাতিত করেন। এই বীরত্বের জন্য তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘সিতারা-ই-জুরাত’ লাভ করেন।

সাইফুল আজম ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে জর্ডান সরকারের অনুরোধে পাকিস্তান কয়েকজন ফাইটার পাইলটকে জর্ডান বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টা হিসেবে পাঠানো হয়, যাঁদের মধ্যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম ছিলেন অন্যতম। জর্ডান পৌঁছাবার বছরখানেকের মাথায় ৬ জুন ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল অতর্কিতে আক্রমণ করে সম্মিলিত আরব বাহিনীকে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিসরের সম্পূর্ণ বিমানবাহিনীকে ধ্বংস ও পর্যদুস্ত করে। রানওয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মিসর বিমানবাহিনী তা ব্যবহারই করতে পারেনি। ফলে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী কোনো প্রতিরোধের মুখেই পড়েনি।
মিসরের বিমানবাহিনীর শক্তি ধ্বংস করার পর ইসরায়েলিরা জর্ডানের তুলনামূলকভাবে দুর্বল বিমানবাহিনীকে ধ্বংস ও নিষ্ক্রিয় করতে জর্ডানের প্রধান বিমানঘাঁটি মাফরাক আক্রমণে উদ্যোগী হয়। এ সময় জর্ডান সরকারের অনুরোধে সাইফুল আজম এবং তাঁর অন্য সঙ্গীসহ জর্ডানের বিমানবাহিনীর কম গতিশীল হকার হান্টার নিয়ে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান ডেসল্ট সুপার মিস্টায়ারের মোকাবিলা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে একক আকাশ যুদ্ধে একটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন, অপরটিকে ধ্বংস করেন। উভয় জঙ্গিবিমানের ইসরায়েলি পাইলট ক্যাপলাম গোলান এবং গোডিয়ন ডিয়ন জর্ডানের হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা পড়েন। ইসরায়েলিরা এমন প্রতিরোধ আশা করতে পারেনি। এই সফলতা ছাড়া জর্ডান আর কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি।

পরদিন অর্থাৎ ৭ জুন ১৯৬৭ জর্ডানের বিমানবাহিনীর যুদ্ধ করার মতো অবস্থা না থাকলে সাইফুল আজমকে ইরাকে পাঠানো হয়। ইরাকে তিনি পুনরায় আকাশযুদ্ধে ইসরায়েলের ভেটোর বোম্বারের চারটি এবং যার পাহারায় ছিল সিরাজ-৩ সি, আক্রমণ করেন। ওই আক্রমণে তিনি একটি বোম্বার এবং সিরাজ-৩ সি ভূপাতিত করেন। এটাই ছিল আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের ইতিহাসে একজন পাইলটের দ্বারা ইসরায়েল বিমানবাহিনীর সর্বোচ্চ ক্ষতি। সাইফুল আজমের এই কৃতিত্ব বিশ্বের বিমানযুদ্ধের একটি মাইলফলক। এই অনন্য ইতিহাসের কারণে তাঁকে লিভিং ইগল বা জীবন্ত ইগলের ২২ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক ইতিহাসে জায়গা করে নেন।

আমার সঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজমের ব্যক্তিগত পরিচয় হয় তাঁর পাকিস্তান থেকে ফেরার পর; যদিও তাঁর নাম ১৯৬৬ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পর এবং ১৯৬৫ সালেও শুনেছি। আরও পরে ১৯৬৭ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর তার তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এমনকি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতেও পড়েছি। উল্লেখ্য, ওই যুদ্ধে সম্মিলিত আরব বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। হারিয়েছিল সম্পূর্ণ সানাই, পশ্চিম তীর গাজা, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি। গাজা আর সানাই ছাড়া বাকি সব অঞ্চল এখন ইসরায়েলের দখলে। আরবদের মুখ রক্ষা করেছেন এই বাঙালি বিমানযোদ্ধা।

সাইফুল আজম একজন দুরন্ত সাহসী এবং বিশ্বখ্যাত বিমানযোদ্ধাই ছিলেন না, মানুষ হিসেবে নিরহংকার ও বন্ধুবৎসল ছিলেন। দারুণ অমায়িক মানুষ ছিলেন। তাঁর নাম ইসরায়েলিদের সামরিক ইতিহাসেও উল্লেখিত রয়েছে।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কৃতিত্বের কারণে পাকিস্তান সরকার সিন্ধু প্রদেশে কয়েক শ একর জমিও দিয়েছিল। কিন্তু সাইফুল আজম সেগুলো ছেড়ে বাংলাদেশের বাহিনীতে অবদান রাখতে দেশে ফিরে আসেন।

তাঁর মৃত্যুতে পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব নিউজ, জর্ডান টাইমসহ অনেক পত্রিকায় বিস্তারিতভাবে তাঁর বীরত্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জর্ডানের প্রিন্স তালাল বিন আবদুল্লাহ, বর্তমান শাসকের চাচা, ব্যক্তিগতভাবে শোক জানিয়েছেন। কাশ্মীর নিউজে আলোচিত হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা শোক প্রকাশ করে বলেছে, তিনি তাদের বন্ধু ছিলেন এবং তাদের মুক্তির জন্যই যুদ্ধ করেছিলেন। আল-জাজিরা বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করেছিল।

তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের গণমাধ্যমে তেমন জায়গা পায়নি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম বাংলাদেশের গর্বিত এক সন্তান। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি তাঁকে আন্তর্জাতিক নায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তিনি পরিণত বয়সে বেশ কিছু সময় অসুস্থ থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে তিনি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল বীর বিমানযোদ্ধা হিসেবে আকাশযুদ্ধের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।

সাইফুল আজমের এমন এক সময়ে মৃত্যু হয়েছে, যখন দেশ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এই আইকনিক ব্যক্তিত্বের বিদায়টি তেমন হয়নি। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। ইউটিউবে তাঁর ওপরে নির্মিত বহু তথ্যবহুল ভিডিও রয়েছে। তিনি অবশ্যই বাংলাদেশের গৌরব এবং তিনি হতে পারেন আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র ফেলো (এনএসইউ)
[email protected]