ক্রসফায়ারে খুশি হচ্ছে কারা

আকা : তুলি
আকা : তুলি

নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ক্রসফায়ার মানুষ গ্রহণ করেছে। মানুষ বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন, তা আমি জানি না। তবে আমার ধারণা, যাঁরা ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন বা এর আশঙ্কায় আছেন, তাঁরা বা তাঁদের বন্ধু-বান্ধব-স্বজন ক্রসফায়ারে খুশি হতে পারেন না। বিগত কয়েক মাসে, বিশেষ করে গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন, গুম হয়েছেন বা নিখোঁজ আছেন। তাঁদের প্রায় সবাই বিএনপি বা এর মিত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী। এসব ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনা বিরোধী দলগুলোর নেতা, সংগঠক, কর্মী ও সমর্থকদের প্রাণভয়ে আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট। এমন আতঙ্ক কারোর খুশিমনে গ্রহণ করার কথা নয়। ক্রসফায়ার বা গুম যদি কারও স্বার্থসিদ্ধি বা প্রতিশোধস্পৃহা পূরণ করার জন্য করা হয়, তিনি যদি অসুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হন, তাহলে তাঁরই একমাত্র এতে খুশি হওয়ার কথা।
মন্ত্রী বা নেতারাও মানুষ, মানুষের পাশবিক মৃত্যু নিশ্চয়ই তাঁদেরও বিচলিত করে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে আমরা আসাদুজ্জামান নূরের ওপর বর্বর আক্রমণের ঘটনা দেখে বিচলিত হয়েছিলাম। ঘটনার দুই দিন পরে বাংলাভিশনে একটি টিভি অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে আমার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম। নূর এ ঘটনায় কষ্ট পেয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে কেঁদে ফেলেছিলেন। তাঁর কান্না অন্য সবার মতো আমাকেও স্পর্শ করেছিল। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর গাড়িবহরে আক্রমণ করে দলীয় পাঁচজন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত চারজন আসামি একে একে ক্রসফায়ারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নূর একজন শিল্পী মানুষ; হূদয়বান ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। আমি জানি না এসব হত্যাকাণ্ড তিনি ঠেকাতে পারতেন কি না। কিন্তু এটি আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে আসাদুজ্জামান নূর এসব অপঘাতে মৃত্যুতে কষ্ট পাননি! শিল্পীর হূদয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যয় থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে পারে না। তাই আমি মনে করি না, নূরের ওপর হামলাকারীদের ক্রসফায়ার বা হত্যাকাণ্ড তিনি গ্রহণ করেছেন।
নূরের মতো সংবেদনশীল, হূদয়বান বা ভালোবাসাময় বহু মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে রয়েছেন। সরকারের মধ্যে আমার খুব চেনা এমন মন্ত্রীরাও আছেন, যাঁরা কখনো বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারেন না। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বহুবার শর্তহীনভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। ক্রসফায়ারের শিকার বিরোধী দলের কর্মী হোক বা তখনকার সরকারি দলের কমিশনার বা যুব সংগঠনের (যুবদল) নেতা হোক, কোনো ক্রসফায়ারেই আওয়ামী লীগ অতীতে উল্লসিত হয়নি, কোনোটিই গ্রহণযোগ্য বলেনি। ২০০৯ সালের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দিয়েছিল। অথচ আমার যত দূর মনে পড়ে, ২০১৩ সালের নির্বাচনের ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ এমন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর একটি মানে হতে পারে, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী কেউ কেউ এখন ক্রসফায়ারে বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই শুধু তাঁদের শাসনামলের জন্য। আওয়ামী লীগে একটি লোকও থাকা সম্ভব নয়, যিনি বলতে রাজি হবেন যে ভবিষ্যতে বিরোধী দলে গেলেও তাঁরা ক্রসফায়ার সমর্থন করবেন! আর এখনকার ক্রসফায়ার সমর্থন করছেন— এমন লোক আওয়ামী লীগেও খুব বেশি আছে বলে আমি মনে করি না।
এমন মনে করার কারণ রয়েছে; এই লেখা লেখার সময় দেখলাম, প্রথম আলোর প্রতিদিনের অনলাইন জরিপে ৮২ শতাংশ মানুষ ক্রসফায়ারের বিপক্ষে মতামত জানিয়েছেন। সরকার ও তার সুবিধাভোগীরা ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী, জঙ্গি আর নাশকতাকারী—এ ধরনের সার্বক্ষণিক প্রচারণা চালানোর পরও এর পক্ষে মতামত দিয়েছেন প্রায় ১৬ শতাংশ মানুষ। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, শাজাহান খান কি মানুষ বলতে এই ১৬ শতাংশকে বুঝিয়েছেন, বাকি ৮২ শতাংশ তাহলে কি মানুষ নন! তাঁর মতো মন্ত্রীরা কয়েক যুগ ধরে রাজনীতি করছেন। মানুষ কারা, আর মানুষের মতামত কি সত্যি বুঝতে পারেন না তিনি?
দুই
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড (ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা গুম) সমর্থন-অসমর্থনের বিষয়ও নয়; এটি গুরুতর অপরাধ, ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে মানবাধিকার। মানবাধিকার শুধু বৈশ্বিক অঙ্গীকার নয়, পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানে স্বীকৃত আদালতে বলবৎযোগ্য অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানে বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ অনুসারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বা ক্রসফায়ার সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলেছে, আইনের চোখে সবাই সমান, সবাই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। ৩১ অনুচ্ছেদ বলেছে যে ‘আইন অনুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ কারও সঙ্গে নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর ব্যবহারই নিষেধ করেছে। ক্রসফায়ার বা গুম বাংলাদেশ সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যাঁরা বলছেন, এসব মানুষ গ্রহণ করেছে, তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করে সংবিধানেরই ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করছেন।
স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী ক্রসফায়ারকে সমর্থন করা বা একে প্রকাশ্যে উৎসাহিত করার মানসিকতা এখনো পোষণ করেন না। সরকার, বিশেষ করে র‌্যাব-পুলিশ বরং নিহত ব্যক্তি ‘সংঘর্ষকালে বা পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে’ ধরনের গৎবাঁধা বুলি আউড়ে থাকে। গুমের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য আরও দায়সারা, আরও অনায়াস। ক্রসফায়ার হলে মৃতদেহ পাওয়া যায়, তার কোনো না কোনো ব্যাখ্যা দিতে হয়। গুম হলে তারও প্রয়োজন নেই। গুমের অভিযোগ করা হলে সরকারের বাহিনী থেকে তাই স্রেফ বলে দেওয়া হয় যে তারা কিছুই জানে না। কিন্তু তাদের এই বক্তব্য কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ গ্রহণ করছে না, করার কথাও নয়।
আমরা বরং কিছু ঘটনাতে হলেও মানবাধিকার কমিশনকে বলতে শুনেছি যে গুম বা ক্রসফায়ারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও এর আলামত পাওয়া যায়। প্রথমত, র‌্যাব বা পুলিশ ছাড়া অন্য কারও পক্ষে লোকজনের, বিশেষ করে গ্রামবাসীর সামনেই কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সাহস করার কথা নয়। দুই, উধাও হয়ে কিছু ক্ষেত্রে ফেরত আসা মানুষেরা আটককালে যে বিশেষ বন্দিশালার বর্ণনা দিচ্ছেন, তা পেশাদার অপরাধীদের তৈরি করে রাখার কোনো কারণ নেই। তিন, অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীরা আটককারীদের গাড়িতে বা পোশাকে র‌্যাব লেখা ছিল বলে যে বর্ণনা দিচ্ছেন, তা অসত্য হওয়ার কথা নয়। র‌্যাবের নামাঙ্কিত পোশাক বা গাড়ি নিয়ে, গ্রামবাসীর সামনে কাউকে ধরে, টর্চার সেলের মতো কক্ষে আটক রাখার দুঃসাহস যদি পেশাদার অপরাধীদের থাকে, আর তাদের যদি আইনের হাতে সোপর্দ করা না যায়, তাহলে তো অবস্থা আরও ভয়ংকর!

তিন
ক্রসফায়ারের সঙ্গে বরং সরকারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গুম বা উধাও করার ঘটনাও সরকারের বাহিনী করছে—এমন অভিযোগ ক্রমে আরও জোরালো হয়ে উঠছে। এ ধরনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তদন্ত কিংবা নথিভুক্ত করতে পুলিশ যে অনীহা দেখাচ্ছে, তাতে এই সন্দেহ আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। দৈনিক মানবজমিন-এর ১০ মার্চের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েই চলছে।...মাসের পর মাস গুম হয়ে থাকলেও তাদের উদ্ধারে তৎপরতা ও ঘটনা তদন্তে অনীহা দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে গুম হওয়া কোনো ব্যক্তিকে উদ্ধার করা যায়নি। এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করছেন, গুম বা নিখোঁজের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত থাকায় তাঁরা এ নিয়ে কোনো তদন্তও করেন না। এ কারণে অন্য অনেক অপরাধী গ্রেপ্তার হলেও গুম হওয়া কোনো ব্যক্তি উদ্ধার কিংবা এর সঙ্গে জড়িতরা কেউ গ্রেপ্তার হয় না।’
সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব যেকোনো নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, কোনো মানুষ উধাও বা খুন হলে দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের জন্য সোপর্দ করা। সরকার যদি এটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দুটো অনুসিদ্ধান্তই কেবল নেওয়া সম্ভব। এক, সরকার নিজে তা করেছে বলে বিচার করতে অনিচ্ছুক। দুই, সরকার অপরাধী শনাক্ত বা অপরাধটির বিচার করতে অক্ষম। যদি এর একটিও সত্যি হয়, তাহলে সেই সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আজকে দূরের মানুষ মারা যাচ্ছে, আগামীকাল মারা যাবে প্রতিবেশী বা স্বজন, পরদিন খুন বা গুম হব আমরা নিজেরা। আমরা কি এখনো বুঝতে পারছি না তা?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।