করোনাভাইরাস কি কালো রাজহাঁস?

এ যুগের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ নাসিম নিকোলাস তালেবের ২০০৭ সালে লেখা বই ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ আমার ভারি পছন্দের। ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বা ‘কালো রাজহাঁস’ আসলে এক বহু পুরোনো ধারণা। শব্দবন্ধটির প্রথম প্রবক্তা সম্ভবত দ্বিতীয় শতকের রোমান কবি জুভেনাল। কবির ধারণা ছিল, রাজহাঁস কখনো ‘কালো’ হয় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ধারণাকেই বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে মানুষ। ধারণাটি ভাঙতে প্রয়োজন ছিল কেবল একটা কালো রঙের রাজহাঁস। সভ্য সমাজের নথি অনুসারে তা প্রথম দেখলেন ওলন্দাজ অভিযাত্রী উইলেম ডে ভ্লামিন, ১৬৯৭ সালে। ব্যস, যুগান্তের জমে ওঠা ভুল ধারণা ভেঙে হলো খানখান।

‘ব্ল্যাক সোয়ান’ তত্ত্বটা কিন্তু নতুনরূপে হাজির এই একুশ শতকে। প্রথমে নাসিম তালেবের ২০০১ সালের বই ‘ফুল্ড বাই র‍্যান্ডমনেস’-এ। পরে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ বইয়ে। তালেব ‘কালো রাজহাঁস’ অভিধায় ভূষিত করছেন ‘বিরল’ কিন্তু প্রবল প্রভাবশালী ঘটনাবলিকে। যেমন অধিকাংশ রাজহাঁসই সাদা। রাজহাঁস কালো হয় বটে, তবে তা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু একটা কালো রাজহাঁসের অভিঘাত অপরিসীম। বাস্তব জীবনে কালো রাজহাঁসের উদাহরণ দিয়েছেন তালেব—৯/১১-এর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, অন্তর্জালের আবিষ্কার, পারসোনাল কম্পিউটার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি। তালেব লিখছেন, ‘অল্পসংখ্যক ব্ল্যাক সোয়ান ব্যাখ্যা করে আমাদের জীবনশৈলীর সবকিছু। আমাদের ধারণার এবং ধর্মের সাফল্য, ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর গতিশীলতা, আমাদের নিজস্ব জীবনের বিভিন্ন উপাদান। যখন প্রায় ১০ হাজার বছর আগে বরফযুগ ছেড়ে এসেছি আমরা, তখন থেকেই এই ব্ল্যাক সোয়ানসের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে।’ তালেবের ধারণার কালো রাজহাঁস তাই বিরল, ভয়ংকর প্রভাবশালী। এর আবির্ভাবকে অনুমান করা যায় না কিছুতেই। আর এর অভিঘাত পর্যালোচনা করা সম্ভব কেবল ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে, আগে থেকে কিছুতেই নয়।

কালো রাজহাঁস সম্পর্কে এত আলোচনার মূল কারণ অবশ্যই কোভিড-১৯ অতিমারি এবং তার পেছনের করোনাভাইরাস। আমাদের জীবনকালে সার্বিকভাবে পৃথিবী তছনছ করে দেওয়ার মতো সবচেয়ে বড় ঘটনা, যার প্রভাব এতটাই অমোঘ ও সর্বাত্মক যে নিউইয়র্ক টাইমসের কলমচি এবং তিনবারের পুলিৎজার বিজয়ী লেখক টমাস ফ্রিডম্যান তো লিখেই ফেলেছেন যে সময়ের ক্রম ঠিক করার ‘খ্রিষ্টাব্দ’ আর ‘খ্রিষ্টপূর্বাব্দ’র যে প্রচলিত ছকে আমরা অভ্যস্ত, তা পাল্টে নতুন নির্দেশক তৈরি করা যেতে পারে—‘বিসি’, অর্থাৎ ‘বিফোর করোনা’, এবং ‘এসি’, অর্থাৎ ‘আফটার করোনা’। স্বাভাবিকভাবেই এই অতিমারিকে কালো রাজহাঁসের সঙ্গে তুলনা করার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সত্যিই কি এর পূর্বাভাস ছিল না একেবারেই?

করোনার কালবেলায় প্রায় গোটা পৃথিবীই যেন হতভম্ব। ব্যতিক্রমী দু-একটি দেশ ছাড়া প্রায় সবাই যেন চূড়ান্ত রকমের অপ্রস্তুত। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, কোনো না কোনো সাংঘাতিক অতিমারিতে পৃথিবী উজাড় হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস কিন্তু ছিলই। গত দুই দশকেই দুনিয়া দেখেছে অনেকগুলো ভয়ংকর মহামারি। ২০০২-০৩-এর সার্স মহামারি, ২০০৯-এর সোয়াইন ফ্লু, ২০১৩-১৬-র ইবোলা, ২০১৮-র মার্স, ২০১৮-র নিপা, ২০১৫-১৬-র জিকা। মার্ক হোনিগ্স্বামের ২০১৯-এর বই ‘দ্য প্যান্ডেমিক হিস্ট্রি: ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব প্যানিক, হিস্টিরিয়া, অ্যান্ড হুব্রিস’ ২০১৮-র স্প্যানিশ ফ্লু থেকে শুরু করে প্যারট ফিভার, প্লেগ, লিজনারিস ডিজিজ, সার্স, এইচআইভি/এইডস, ইবোলা, জিকা এসব সংক্রামক রোগের ইতিহাসের সঙ্গে পর্যালোচনা করেছে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুঘটক ও বৈজ্ঞানিক দুর্বলতার জায়গাগুলোও।

আসলে দু-চার বছর পরপরই কোথাও না কোথাও মোটামুটি বড় ধরনের মহামারি হওয়াটা এ গ্রহের ভবিতব্য। ২০০৯-এর সার্স মহামারিতেই তো আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবীর ১১-২১ শতাংশ মানুষ। করোনা মহামারি কেবল আরও ধ্বংসাত্মক ও সর্বগ্রাসী হয়ে হাজির হয়েছে পৃথিবীর ভারসাম্যটাকেই তছনছ করে দিতে, এই যা। এই তো করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার মাত্র মাস দু-আড়াই আগে, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন একটা প্রেস রিলিজ বের করে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাট রিস্ক ফ্রম ডেডলি প্যান্ডেমিক’ শিরোনামে, যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণঘাতী হতে পারে এবং বিশ্বের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, এমন অতিমারির আশঙ্কা, পৃথিবীর প্রস্তুতিহীনতার চিত্রণ এবং সম্ভাব্য সতর্কতার পরামর্শ। সেখানে কিন্তু পরিষ্কার বলা হয়, বহুচর্চিত ১৯১৮-র স্প্যানিশ ফ্লুর সমতুল্য কোনো অতিমারি হলে আজকের পৃথিবীতে মৃত্যু ঘটতে পারে পাঁচ থেকে আট কোটি মানুষের, মুছে যেতে পারে পৃথিবীর ৫ শতাংশ অর্থনীতি। গ্লোবাল প্রিপেয়ার্ডনেস মনিটরিং বোর্ডের সহসভাপতি ডা. গ্রো হারলেম ব্রান্ডল্যান্ড সেখানে বলেছেন, ‘দীর্ঘকাল ধরেই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জরুরি বিষয়ে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যায়ক্রমে আতঙ্ক ও অবহেলার মধ্যে চাকার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আবশ্যিক ও দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপের এটা উপযুক্ত সময়।’ আবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট’ অনুসারে সংক্রামক অসুখকে ২০২০-এর ক্ষেত্রে ঝুঁকির এক প্রধান কারণ হিসেবে বলা ছিল। ওদিকে বছরখানেক আগেই মার্কিন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ‘মার্ক শার্প অ্যান্ড ডোম’ সতর্ক করেছে যে মর্মান্তিক পরিণতিসাপেক্ষ সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব একপ্রকার ‘নিশ্চিত’।

তাই করোনাভাইরাসের মতো কিছু যে কালো রাজহাঁসের মতো অপরিজ্ঞাত ছিল, এ কথা একেবারেই ঠিক নয়। গোটা দুনিয়া জানত, এমন কিছু একটা আসতে পারে, আসতে চলেছে, যেকোনো দিন। নামকরা মার্কিন সমীক্ষক সংস্থা ‘ফাইভথার্টিএইট’-এর নেইট সিলভার যেমন করোনাকে বলার চেষ্টা করেছেন এমন কালো রাজহাঁস, যাকে দেখার আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি। জনপ্রিয় মার্কিন লেখিকা মিশেল উকার আবার করোনাভাইরাসের পদধ্বনি কেউ শোনেনি, এমন আশঙ্কাকে ‘অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। উকার নিজে কিন্তু একটা বেশ ফ্যাশনদুরস্ত শব্দবন্ধের প্রবক্তা। ২০১২-তে গ্রিসের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আশঙ্কাজনক অথচ উপেক্ষিত, কিন্তু প্রবল প্রভাবশালী বিপদকে উকার বলেন ‘গ্রে রাইনো’ বা ‘ধূসর গন্ডার’। পরবর্তীকালে ২০১৬-তে ‘দ্য গ্রে রাইনো: হাউ টু রেকগনাইজ অ্যান্ড অ্যাক্ট অন্য দ্য অবভিয়াস ডেঞ্জার্স উই ইগনোর’ নামে বইটি লিখেছেন উকার। তিনি উইকিপিডিয়াতে দেখেন যে কালো গন্ডার আর সাদা গন্ডারের কথা রয়েছে সেখানে। কিন্তু কালোগুলো আসলে কালো নয়, সাদাগুলো সাদা নয়। বাস্তবে সবাই ধূসর। অথচ গন্ডার যে ধূসর, এই সহজ কথাটা কেউ বলেনি। ঠিক তেমনি করেই ভয়ানক অতিমারির আশঙ্কাও থেকে গিয়েছে আমাদের চোখের সামনে। দেখেও দেখেনি কেউ।

আসলে যেকোনো ‘ব্ল্যাক সোয়ান’-এর পটভূমিকায় থাকে এমনই একঝাঁক ধূসর গন্ডার। চোখের সামনে। আমরা দেখেও দেখি না। ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালজুড়ে এমনই অনেক ইঙ্গিত ছিল আসন্ন মন্দার। পারসোনাল কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেটও নিশ্চয়ই আকাশ থেকে এসে পড়েনি। তিল তিল করে এগিয়েছে গবেষণা। এমনকি ৯/১১-এর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের আগে থেকেই সুরক্ষায় গলদ ছিল স্পষ্ট। আমরা দেখেও দেখিনি, এই যা।

আর একটা শব্দবন্ধও আকর্ষণীয় ঠেকতে পারে এ প্রসঙ্গে। কয়েক বছর আগে টমাস ফ্রিডম্যানের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিখ্যাত পরিবেশবিদ অ্যাডাম সুইডান ধারণা দিয়েছিলেন ‘ব্ল্যাক এলিফ্যান্ট’ বা কালো হাতির। সেই যে প্রবাদ রয়েছে—‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’, অর্থাৎ ঘরের মধ্যে হাতি আছে, সবাই দেখছে, কিন্তু সে বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় কেউই। এর সঙ্গে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’-এর ধারণাটাকে ‘হাঁস-হাতি’ ধরনের ‘খিচুড়ি’ বানিয়ে পরিবেশন করা আরকি। ঘরের মধ্যে চলেফিরে বেড়ানো হাতিটাকে সবাই দেখেছে, সে নিয়ে আলোচনা করতে সবারই তীব্র অনীহা, কিন্তু একদিন সেই হাতিটা যখন তেড়েফুঁড়ে বেরোবে, তার অভিঘাত হবে ব্ল্যাক সোয়ানের মতোই প্রবল ও সর্বাত্মক।

একটু ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে কালো রাজহাঁস আসলে ‘অপরিজ্ঞাত অজ্ঞাত’র উদাহরণ, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আননোন আননোন’, যা আমরা জানি না যে আমরা জানি না। ধূসর গন্ডার হলো ‘পরিজ্ঞাত জ্ঞাত’র উদাহরণ, ইংরেজিতে ‘নোন নোন’, যা আমরা জানি যে আমরা জানি। ওদিকে কালো হাতি হলো ‘পরিজ্ঞাত অজ্ঞাত’, ইংরেজিতে ‘নোন আননোন’। আমরা জানি যে আমরা জানি না। এ প্রসঙ্গে খানিকটা কম প্রচলিত চতুর্থ ধারণাটি হলো ‘অপরিজ্ঞাত জ্ঞাত’, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘আননোন নোন’, যার একটি চালু উদাহরণ ‘কালো জেলিফিশ’। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জেলিফিশের বংশবৃদ্ধির আদর্শ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলে। আর এর ফলে জেলিফিশ সংখ্যায় বিপুলভাবে বেড়ে গিয়ে উপকূলবর্তী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। কীভাবে ছোট জিনিসগুলো অনুকূল পরিস্থিতিতে বিপুল প্রভাব ফেলে অচিন্তিত ভবিষ্যতের জন্ম দিতে পারে, জেলিফিশ তার আদর্শ উদাহরণ। ভেবে দেখলে হয়তো করোনাভাইরাসও বাস্তবিক অর্থে ‘আননোন নোন’। জেলিফিশই হয়তো তার নিকটতম প্রাণী-রূপক।

যা-ই হোক, আসল কথা হলো, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের সেপ্টেম্বরের প্রেস রিলিজে পরিষ্কার বলা ছিল যে ক্রমশ বেড়ে চলা সর্বগ্রাসী অতিমারির আশঙ্কা সত্ত্বেও পৃথিবী কিন্তু অপ্রস্তুত। সার্স বা সোয়াইন ফ্লুর মতো অতিমারি থেকে বড় একটা শিক্ষা নেয়নি পৃথিবী, সে কথা স্পষ্ট। আশা করা যাক, করোনা অতিমারি এরপর আমাদের প্রতিনিয়ত ধূসর গন্ডার খোঁজার চোখ তৈরিতে উৎসাহ দেবে, যাতে কালো রাজহাঁস বা কালো হাতিকে এড়ানো যায়, যতটা সম্ভব। আমরা হয়তো কালো জেলিফিশের অবাঞ্ছিত বংশবৃদ্ধি আটকাতে নিয়ত সচেষ্ট থাকব। আশা করব, সেটাই হবে এ কালবেলার উত্তরাধিকার।

*অতনু বিশ্বাস, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক