মৃত্যুর মিছিল থামাতেই হবে

প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটু অভিনিবেশসহকারে চোখ রাখি। করোনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের অল্প কজনেরই ছবি ছাপা হচ্ছে তিন দিন ধরে। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা সংখ্যা নন। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। ছবিগুলোই তা বলে দিচ্ছে। প্রত্যেকের মুখ আলাদা, অভিব্যক্তি আলাদা। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে! শিশুসন্তানদের রেখে মারা গেছেন মা। তরুণ মারা গেছেন তরুণী স্ত্রী ও শিশুসন্তানদের রেখে। সদ্য বিধবা জানেন না, তাঁর স্বামীর কোনো জমানো টাকা আছে কি না! পুরো পরিবার অসহায়। 

সরকারি হিসাবেই গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৩৪৩ জন। কিন্তু আমরা জানি, কোভিডের লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন আরও অনেকে। এই মৃত্যুমিছিল থামাতে হবে। আর কোনো সন্তান যেন করোনার কারণে পিতৃহারা না হয়, আর কোনো মা যেন সন্তানহারা না হন। 

মৃত্যু কমাতে হলে সংক্রমণ কমাতে হবে। আমরা প্রথম সুযোগ হারিয়েছি চীনে করোনা দেখা দেওয়ার পর আমাদের বিদেশফেরতদের শনাক্ত ও পৃথক করতে না পেরে। এরপর বাংলাদেশে ৮ মার্চ যখন প্রথম করোনাক্রান্তকে শনাক্ত করা হলো, তারপর স্কুল ছুটি দেওয়া হলো, সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হলো। ওই সাধারণ ছুটির সময়টাতে যদি আমরা কঠোর লকডাউন করতে পারতাম, প্রতিটা মানুষকে জরুরি প্রয়োজন ব্যতিরেকে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারতাম, তাহলেও করোনা সংক্রমণ কমানো যেতে পারত। 

আমরা কিন্তু আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি স্বীকার করে নিয়ে, খেটে খাওয়া মানুষদের ভোগান্তির কথা বিবেচনায় রেখেও দীর্ঘদিন অফিস-আদালত-কলকারখানা-যানবাহন বন্ধ করে রেখেছিলামই। কিন্তু যা করা যায়নি তা হলো লকডাউন কঠোরভাবে মান্য করা। সরকারিভাবে কখনো লকডাউন কথাটা উচ্চারণ করাও হয়নি। নির্দেশনায় অস্পষ্টতা ছিল। সমন্বয়ের অভাবও ছিল। 

ছুটি কথাটা শুনেই হাজার হাজার মানুষ ছুটল বাড়ির দিকে, ফেরিতে গাদাগাদি করে উঠল অযুত মানুষ। প্রথমে তো সমুদ্রসৈকতে মেলাও বসে গিয়েছিল। এরপর এপ্রিলের শুরুতে পোশাক কারখানা খোলা থাকবে নাকি বন্ধ থাকবে, এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচল। আমরা দেখলাম শ্রমিক-কর্মচারীদের ঢাকামুখী স্রোত। অনেকে তো মাইলের পর মাইল হেঁটে ঢাকায় পৌঁছালেন এবং তখন বলা হলো, কারখানা বন্ধ থাকবে। 

এরই মধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটে গেছে। তার মধ্যে এত ঘনবসতির দেশ। আর তথাকথিত সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং আমাদের দেশে বাস্তবে সম্ভব নয়। নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫০ লাখ, আয়তন আমাদের দেশের দ্বিগুণ, ওদের মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ডলার। আমাদের মিরপুরেই তো ৫০ লাখ লোক বাস করে। আমরা মানুষকে যে ঘরে থাকতে বলব, বহু মানুষের তো ঘরই নেই। আমাদের একটা ঘরে ১০ জন লোক ঘুমায়। এই জন্য গ্রামভিত্তিক বা মহল্লাভিত্তিক লকডাউনই আদর্শ বলে মনে করি, যা করা হয়েছে মিরপুরের টোলারবাগে। মডেল হতে পারত ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আনন্দবাগ গ্রাম। গ্রামে প্রবেশের তিনটা রাস্তাতেই চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল। বাইরের কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না, ভেতরের কেউ বাইরে যেতে পারবে না। ১৪০ পরিবার, ২ হাজার মানুষ। কম সামর্থ্যের পরিবারগুলোকে চাল-ডালও পাঠানো হচ্ছিল। 

এখনো এই মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিটা গ্রামের মানুষেরা নিজেরা সংগঠিত হবেন। তাঁরা তাঁদের গ্রামে বাইরে থেকে কেউ এলে তাঁকে আলাদা করে রাখবেন। সে ক্ষেত্রে দরকার হবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, সে জন্য দরকার হবে মানুষকে যুক্ত করা। এই কাজটাই প্রথম থেকে হয়নি। সরকার কতগুলো সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল। যেগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ দরকার ছিল আগাগোড়া। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো শোনাচ্ছিল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মতো। মানুষ কী করবে, তা মানুষ বুঝছিল না। 

একই কথা প্রযোজ্য চিকিৎসার বেলাতেও। সরকারের হাতে পরীক্ষার কিট ছিল কম। সরকার করোনার টেস্ট বা পরীক্ষাটাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখল! এটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত যে সরকার টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় ঢাকা থেকে লোক পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পরীক্ষা করে তারপর ফল দেবে? দরকার ছিল সরকারি, আধা সরকারি, এনজিও, আন্তর্জাতিক, বহুজাতিক, বেসরকারি সবগুলো প্রতিষ্ঠান এবং জনশক্তিকে করোনো মোকাবিলার কাজে শামিল করা। আইসিডিডিআরবিকে প্রথম দিন থেকেই কাজে লাগানো যেতে পারত! 

সরকার যদি প্রথম দিন থেকে বলে দিত যেকোনো অনুমোদিত হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিজেরা কিট আমদানি করে করোনার পরীক্ষা করতে পারবে, তবে মান এবং ফিসের অঙ্ক তদারক করবে সরকার, তাহলে বেসরকারি উদ্যোগেই করোনার টেস্ট সারা দেশে সহজপ্রাপ্য হয়ে যেত। এই কাজটা এখনো করা যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিই। ঢাকার শিশু হাসপাতালে করোনা ইউনিট নেই। তারা করোনা ইউনিট খুলতে চায়, এ জন্য তাদের সহযোগিতা লাগবে। কী লাগবে, এটা জেনে সরকার যেমন তা সরবরাহ করতে পারে, তেমনি বাংলাদেশে বহু বেসরকারি উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা শিশু হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে করোনা ইউনিট স্থাপনের পুরো খরচ অনুদান হিসেবেই দিতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে পারেন। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালকের একটা কথা আমার কানে বাজে। মার্চে তিনি বলেছিলেন, উই আর বায়িং টাইম। আমরা সময় কিনছি। কারণ, চিকিৎসাব্যবস্থার ওপরে যাতে একসঙ্গে চাপ না পড়ে। যাতে হাসপাতালগুলো, চিকিৎসাব্যবস্থা, সরকার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পায়। আমরা তো সময় পেয়েছিলাম। চড়া মূল্য দিয়ে দেশে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুই মাস বন্ধ করে রেখেছিলাম। এই সময়টাতে আমরা করলামটা কী? 

শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক চিকিৎসা দিয়ে হবে না। আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। সেখানে আলাদা করোনা ওয়ার্ড বসিয়ে অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে করোনার চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। টেলিমেডিসিন এখন খুবই কার্যকরী। এটা আরও নির্বিঘ্ন করতে হবে। প্রথম কলেই যেন ফোন রিসিভ করা হয়। এ জন্য সদ্য পাস করা ডাক্তারদের পর্যাপ্ত সংখ্যায় টেলিফোনের পাশে নিয়োজিত রাখা যায়। দরকার অন্য সব স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা। গর্ভবতী নারী, প্রসূতি মা, শিশুরা যেন সেবা পায়। অসংক্রামক ব্যাধি এবং করোনা ছাড়া অন্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা যেন অব্যাহত থাকে। 

সরকারের সামনে কি কোনো রুট ম্যাপ আছে, কী করে করোনায় নতুন সংক্রমণ শূন্যে আনা যাবে? আমরা কবে এবং কীভাবে বের হয়ে আসতে পারব করোনার কালো ছায়ার নিচ থেকে? 

এই পুরো ব্যাপারটার জন্য দরকার জনগণের অংশগ্রহণ। সমাজের অংশগ্রহণ। রবীন্দ্রনাথ এই কথাটা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন। আমাদের দেশ সব সময়ই সমাজের শক্তিতে চলে এসেছে, রাষ্ট্রের শক্তিতে নয়। পুকুর কাটা, টোল বানানো—এসব সমাজই করত। স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘এখন জলদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, স্বাস্থ্যদানের কর্তা সরকার বাহাদুর, বিদ্যাদানের ব্যবস্থার জন্যও সরকার বাহাদুরের দ্বারে গলবস্ত্র হইয়া ফিরিতে হয়। যে-গাছ আপনার ফুল আপনি ফুটাইত, সে আকাশ হইতে পুষ্পবৃষ্টির জন্য তাহার সমস্ত শীর্ণ শাখাপ্রশাখা উপরে তুলিয়া দরখাস্ত জারি করিতেছে। নাহয় তাহার দরখাস্ত মঞ্জুর হইল, কিন্তু এই-সমস্ত আকাশকুসুম লইয়া তাহার সার্থকতা কী?’

সরকার একা করোনা মোকাবিলা করবে, এটা আকাশকুসুম চিন্তা। সবাইকে সঙ্গে নিন। করোনা মোকাবিলার অভিযানের নৌকাটিতে সবাইকে স্থান দিন। এবং তার নেতৃত্ব দিতে স্থানীয় সমাজকে দায়িত্ব পালন করতে উদ্বুদ্ধ করুন। আমরা বড় বেশি কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছি। এটা বাস্তবে সুফল দেবে না। 

চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, দায়িত্ব পালনকারী সর্বস্তরের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, তাঁদের মনোবল চাঙা রাখুন। আর সিদ্ধান্তগুলো জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। রেড জোন মানে কী? রেড জোন কতটুকুন? রেড জোনের অধিবাসীরা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না, তা কিন্তু কেউই জানে না। মানুষকে অবহিত রাখুন, উদ্বুদ্ধ করুন। 

১৯৭১-এ আমরা জয়ী হয়েছিলাম, কারণ বঙ্গবন্ধু পুরো দেশকে এক মন্ত্রে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব যুদ্ধ, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সম্মিলিত যুদ্ধ। আজকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সেই রকম সব মানুষের অংশগ্রহণ দরকার হবে। 

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক