ঔপনিবেশিক ইতিহাস বিচারের কাঠগড়ায়

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

ইউরোপীয় জাতিগুলোর ঔপনিবেশিক ইতিহাস নিয়ে নতুন প্রজন্মের ইউরোপীয়রা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, ব্রাসেলস, আমস্টারডামসহ ছোট-বড় নানা শহরে তাদের প্রতিবাদ চলছে। তারা বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা ঔপনিবেশিক আমলের ‘জাতীয় বীর’দের মূর্তিগুলোর গলায় দড়ি বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনছে। এভাবে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের এই অন্যায়ের দায়মোচনের চেষ্টা করছে। ৩০০ বছর পর ১৮ শতকের তথাকথিত ‘জাতীয় বীরদের’ আজ এ কী নাস্তানাবুদ অবস্থা!

ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলো সারা পৃথিবী শোষণ করে, উপনিবেশগুলোর মানুষকে দাস বানিয়ে বেচাকেনা করে নিজেদের সম্পদশালী করেছে। তারাই আজ গণতন্ত্র ও মানবতার সবক দিচ্ছে। কিন্তু তারা নিজেদের দেশের পাঠ্যবইগুলোয় তাদের ঔপনিবেশিক আমলের অন্যায়-অবিচারের ইতিহাস সেভাবে লেখেনি। তারা সেসব স্মরণ করতে চায় না।

বর্ণবাদের শিকড় রয়েছে বিশ্বজুড়ে। আমেরিকার বর্ণবাদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৬১৯ সালে প্রথম আফ্রিকার মানুষকে ক্রীতদাস করে আমেরিকার ভার্জিনিয়া রাজ্যে আনা হয়। ১৮৬৫ সালে আমেরিকায় দাসপ্রথা বাতিল করা হয়। ১৮৬৮ সালে আফ্রিকা থকে আনা ক্রীতদাসদের নাগরিক অধিকার প্রদান করা হয়। তবু আমেরিকার বর্ণবাদ অতীত বিষয়ে পরিণত হয়নি, আজও তা চলছে।

কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সেই ইতিহাস আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আর কালো ক্রীতদাসদের বংশধরেরাই শুধু প্রতিবাদ করছে না; যারা তাদের দাস বানিয়ে কেনাবেচা করেছিল, তাদের বংশধরেরাও পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্তে নেমেছে। আর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীরা নিজ নিজ দেশকে অতীতের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করতে চায়।

১৭ শতকে আটলান্টিক ক্রীতদাস ব্যবসার অন্যতম শিরোমণি ছিলেন এডওয়ার্ড কুলস্টন। সেই সময় তাঁর রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানি আমেরিকায় ক্রীতদাস পাচারে ব্যবসায় ছিল সর্বাগ্রে। তাঁর দাস ব্যবসার ধনসম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছিল ব্রিস্টল শহর। সেখানে বীরের মর্যাদায় নির্মাণ করা হয়েছিল তাঁর স্মারক ভাস্কর্য। ক্রীতদাস কোম্পানিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল রাজরাজড়াদের লম্বা হাত। রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানি বা ইংলিশ মার্কেন্টাইল কোম্পানির পেছনে ছিল স্কটল্যান্ডের রয়্যাল স্টুয়াট পরিবার ও ডিউক অব ইয়র্কের মতো রাজপরিবারগুলো।

বিক্ষোভকারীরা সম্প্রতি সেই এডওয়ার্ড কুলস্টনের ভাস্কর্য এভন নদীর পানিতে দিয়েছে। এই বিক্ষোভের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রাজপ্রাসাদের কাছে এক পার্কে রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ডের ভাস্কর্য রাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাল রঙে, যা রক্তের প্রতীক। বেলজিয়ামের আরেক শহর অ্যান্টভের্পে দ্বিতীয় লিওপল্ডের ভাস্কর্যে বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দিলে শহর কর্তৃপক্ষ সেটি সরিয়ে নিয়েছে।

বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড ছিলেন ব্রিটেনের মহারানি ভিক্টোরিয়ার জ্ঞাতিভাই। আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকা ছিল তাঁদের ঐশ্বর্য লুটপাটের খনি। ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড কঙ্গোতে লুটপাট চালাতে গিয়ে এক কোটি মানুষকে হত্যা করেছিলেন। বেলজিয়ামের শিক্ষামন্ত্রী ক্যারলিনা ড্রেজায়ার গত সপ্তাহে বলেছেন, স্কুলের পাঠ্যতালিকায় দেশটির ঔপনিবেশিক ইতিহাসের পুরো বিষয়টি রাখা প্রয়োজন।

বার্মিংহাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্ল্যাক স্টাডির অধ্যাপক কাইন্ডে এনড্রুস গত সপ্তাহে জার্মানির ডের স্পিগেল পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অতীতের ঘটনা বললেই যদি ব্রিটিশ জাতির দায়মুক্তি ঘটে যেত, তাহলে এডওয়ার্ড কুলস্টনের ভাস্কর্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত না বা স্কটল্যান্ডের ক্রীতদাস সওদাগর রবার্ট মিলিগ্রানের ভাস্কর্য লন্ডনের ডকল্যান্ড মিউজিয়ামের সামনে থেকে সরিয়ে নিতে হতো না।’

ব্রিটিশদের জাতীয় বীর উইনস্টন চার্চিলকে নিয়েও কথা হচ্ছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চত্বরে তাঁর ভাস্কর্যটি আপাতত লোহার পাত দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ১৩ জুন ভাস্কর্যটিকে কেন্দ্র করে রক্ষণশীল ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী ও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। লন্ডনে বিক্ষোভকারীরা বলছে, ব্রিটেন এখনো তাদের সাম্রাজ্যবাদ ও বৈষম্যের ইতিহাস ধরে রেখেছে। বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বর্ণবাদবিরোধী কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।

শুধু আমেরিকা নয়, বর্ণবাদী সংস্কৃতি ইউরোপের দেশে দেশে। জার্মান ইতিহাসবিদ ও অভিবাসন গবেষক ইয়াসমিন শুমান লিখেছেন, জার্মানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদচর্চা একটি পুরোনো বিষয় এবং তা এখনো চালু আছে। তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, স্কুলের যে শিক্ষার্থীদের নাম জার্মান নয়, শিক্ষকেরা পরীক্ষায় তাদের কম নম্বর দেয়। জার্মানিতে এখনো শিক্ষা, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে বর্ণগত ও জাতিগত বৈষম্য রয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের সহিংস মৃত্যুর পর আটলান্টিকের উভয় পারে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। আর তা শুধু বর্তমানেই সীমাবদ্ধ নেই, অন্ধকার ইতিহাসকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে।

সরাফ আহমদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]