মহামারির সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

অন্য রকম ও অভূতপূর্ব এক সময়ে এখন আছি আমরা। কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে দাবানলের মতো। জীবন ও জীবিকা উভয়ই আজ ক্ষতিগ্রস্ত। জীবনযাপনও আজ অনেকটাই পরিবর্তিত। কবে আবার সবকিছু আগের মতো হবে, কেউ জানে না। জীবন বাঁচানোর এই যুদ্ধে সবাই যখন লড়ছে, তখন আরেকটি গুরুতর সমস্যা পৃথিবীতে চলছে, তা হলো শরণার্থী সমস্যা। আজকের এই বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমরা স্মরণ করি শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী ও অন্যান্য বাস্তুচ্যুত মানুষদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই এবং তাদের দৃঢ় প্রত্যয়কে। প্রতিদিনই তাদের বিপদ মোকাবিলা করার, প্রতিকূলতাকে জয় করার ও জীবন গড়ার ইচ্ছা নতুন করে প্রকাশ পায়। নিজেকে একবার তাদের অবস্থানে ভাবুন। ভাবুন আপনি তাদের জায়গায় থাকলে অন্যদের কাছ থেকে কী আশা করতেন। যে কেউই জীবনের কোনো সময় শরণার্থী হয়ে পড়তে পারে, এটাই বাস্তবতা।

প্রতিবছর শরণার্থী দিবসের আগে আমরা গ্লোবাল ট্রেন্ডস ইন ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট রিপোর্ট প্রকাশ করি। প্রায় এক দশক ধরে প্রতিবছরই বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল রেকর্ডসংখ্যক। টেকসই সমাধান হয়ে পড়ছে দুরূহ। ২০১৯ সালের শেষে সারা পৃথিবীতে ৭ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ ছিল বাস্তুচ্যুত। মানে প্রতি এক শ জনে গড়ে একজনের বেশি মানুষ শরণার্থী অথবা নিজ দেশের ভেতর বাস্তুচ্যুত। এগুলো শুধুই সংখ্যা নয়, এর পেছনে আছে একেকটা মানুষ ও তাদের পরিবারের গল্প। আছে তরুণদের স্বপ্ন ও প্রবীণদের শেষ বয়সে একটু ভালো থাকতে চাওয়া।

বাংলাদেশের জনগণের মানবিকতা ও সহানুভূতির জন্য পৃথিবী কৃতজ্ঞ। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে তাঁরা আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এশিয়ায় কখনো এত বেশিসংখ্যক মানুষ এত দ্রুত শরণার্থী হয়নি। রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশিদের উপকার ভোলেনি। এ দেশে তারা পেয়েছে নিরাপত্তা ও আশ্রয়, তখন এটিই সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল তাদের। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অনেকেই সবকিছু ফেলে তখন কক্সবাজারে ছুটে গিয়েছিলেন মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করতে প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্থানীয় বাংলাদেশিরা। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রতম মানুষগুলোও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজ ঘরে থাকতে দিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের, সামান্য খাবারটুকুও ভাগাভাগি করে খেয়েছেন শরণার্থীদের সঙ্গে। মানবতা ও বাংলাদেশের ইতিহাসে এঁরাই সত্যিকারের নায়ক। এ বছরের বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘এভরি ওয়ান ক্যান মেক আ ডিফরেন্স, এভরি অ্যাকশন কাউন্টস’। অর্থাৎ প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেকেই পারে পরিবর্তন আনতে। বাংলাদেশের মানবিক জনগণ এই প্রতিপাদ্যের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি।

আজ এ দেশের মানুষের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও নতুন এক সংকটের মুখোমুখি। কোভিড-১৯ মহামারি বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। এই ভাইরাস কোনো ভেদাভেদ করে না। শরণার্থী, বাংলাদেশি, বিদেশি সাহায্য সংস্থার কর্মী সবাই সমান ঝুঁকিতে রয়েছেন। শরণার্থী ক্যাম্পে শুধু অতি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম ছাড়া বাকি সব ধরনের চলাফেরা নিষিদ্ধ করার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। এর মাধ্যমে ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের আগমন বিলম্বিত করা সম্ভব হয়েছে, কমানো গেছে সংক্রমণের বিস্তার। আমরা এই সময়টুকুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে। কক্সবাজারে আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে, কাজও শুরু হয়ে গেছে। কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত এ জেলায় ৪৩ জন রোহিঙ্গাসহ মোট ১ হাজার ৮৫২ জন কোভিড–১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

জাতিসংঘ, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো শরণার্থীদের সুরক্ষা প্রদানের পাশাপাশি কক্সবাজারে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে আমরা কক্সবাজারের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়েছি, বাংলাদেশি ও শরণার্থী রোগীদের সমানভাবে সেবার জন্য তৈরি করেছি নতুন আইসোলেশন অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট সেন্টার।

ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে রাখা যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন অতি জরুরি কিছু সাহায্য চালু রাখা। তাই কিছুসংখ্যক সম্মুখ সারির মানবিক কর্মী কাজ করছেন জীবন রক্ষাকারী স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে এবং খাদ্য, জ্বালানি, সাবান ও পরিচ্ছন্নতাসামগ্রী বিতরণে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও বসে নেই। তাদের কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে যেন সবাই জানতে পারে কীভাবে কোভিড–১৯ সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকা যায়; অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে কী করতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা, পরিচ্ছন্নতা ও গণসচেতনতামূলক কাজে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

একটা চ্যালেঞ্জিং সময় আমরা পার করছি। এর মধ্যেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশের মানুষের উদ্যোগ আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। সরকার, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও এবং আমাদের ইউএনএইচসিআর টিমের মানবিক প্রত্যয় আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁরা প্রতিদিন নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভুলে অন্যের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলার পাশাপাশি আমাদের কাজ করতে হবে যেন কেউই আজীবন শরণার্থী হিসেবে থেকে না যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সম্প্রতি দেখেছি, ভবিষ্যতের আশা হারানো শরণার্থীরা বেপরোয়াভাবে নতুন জীবনের আশায় সাগর পাড়ি দিতে চাইলে তার পরিণাম কেমন হয়।

আমি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পরিষ্কারভাবে এটা এখনো শুনছি, ‘আমরা আমাদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।’ স্বাভাবিকভাবেই তারা এটাও চায় যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সহিংসতা থেকে বাঁচতে পারে, যেন তারা চলাফেরার স্বাধীনতা, কিছু মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা নিয়ে মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারে।

জাতিসংঘের মহাসচিব পৃথিবীর সব প্রান্তে জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। এটা জরুরি ভিত্তিতে, বিশেষভাবে প্রয়োজন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। সেখানে আরও প্রয়োজন শান্তি ও ন্যায়বিচার; যেন রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও স্বমর্যাদায় নিজ দেশে ফিরতে পারে; যেন এরপর তাদের আর পালাতে না হয়।

এটাই হওয়া উচিত আজকের বিশ্ব শরণার্থী দিবসে রোহিঙ্গা ও সব বাস্তুচ্যুত মানুষের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার।

স্টিভেন করলিস: জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হা্ইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) বাংলাদেশ প্রতিনিধি