মোদির ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে ভারতকে

‘যারা ইতিহাস মনে রাখে না, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির দায় তাদেরই’—স্প্যানিশ দার্শনিক হোর্হে সান্তাইয়ানার এই বাণী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চীন নীতির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় তাঁর দেশ যে ভুল করেছিল, তা মনে রাখার বিষয়ে তিনি উদাসীন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যেভাবে চীন ইস্যুতে তাঁর রাশিয়াপন্থী উপদেষ্টা ভি কে কৃষ্ণ মেননের ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে ভুল করেছিলেন, মোদিও সেই একই ভুল করছেন। মোদি তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শংকরের পরামর্শ শুনে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এবং আগামাথা না ভেবেই ধরে নিয়েছেন ভারতের কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বড় বান্ধব তার আর হবে না। কিন্তু ১৯৬২ সালে ভারত যেভাবে রাশিয়াকে পাশে পায়নি, এখন একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেও পাচ্ছে না।

মোদি ২০১৯ সালের নির্বাচনে পুনরায় জেতার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বহু ঐতিহ্য ও রেওয়াজ বিসর্জন দিয়েছেন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখাসহ নাগরিকের জীবনযাপনসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ভোটার টানতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে খেলেছেন। সাধারণ ভারতীয়দের ভূখণ্ডগত চেতনাকে ব্যবহার করে তিনি পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হামলাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এটি করতে গিয়ে পাকিস্তানের বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছেন এবং ভোটারদের মন পেতে বলেছেন পাকিস্তানের অধীনে থাকা কাশ্মীরকে তাঁর সরকার ছিনিয়ে আনবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিভিন্ন পরাশক্তির নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলি ও হাত মিলিয়ে নিজের জনগণের কাছে জনপ্রিয় হতে চেয়েছেন। বড় বড় দেশের নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলি ও হাত মেলাতে গেলে মাশুলটাও বড় দিতে হয়। পুতিনের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে মোদিকে এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনা বাবদ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার খরচ করতে হয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে হাত মেলানো দাম বাবদ রাফায়েল চুক্তি করতে হয়েছে, যার খরচ ৩ হাজার কোটি ডলার। পুতিন আর মাখোঁর সঙ্গে হাত মেলাতে না হয় অর্থ গেছে। কিন্তু সি চিন পিং আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বুক মেলাতে গিয়ে দাম দিতে হয়েছে আরও বেশি। সেখানে কৌশলগত ব্যয় হয়েছে অনেক।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেক্সাসের হিউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৫০ হাজার লোকের মধ্যে মোদি সেখানে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তারপর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোয়া লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ট্রাম্পকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন মোদি। ট্রাম্প সেখানে মোদিকে জড়িয়ে ধরে ‘সত্যিকারের বন্ধু’ বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। মোদি ও তাঁর মন্ত্রীরা ভেবেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে, তা থেকে ভারত ফায়দা তুলতে পারে। মোদি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবে। এবং তা লগ্নি করা হবে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে যতখানি শক্তি নিয়ে নেমেছে বলে মোদি মনে করেছেন, আসলে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ঘোষণা করেছে। নীতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’র বিরোধিতা করছে না এবং চীনের সরকার বদলানোর কোনো ইচ্ছাও যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কিন্তু মোদি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের ভার্চ্যুয়াল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দুজন পার্লামেন্ট সদস্যকে পাঠিয়ে দিলেন। এতে চীনের চটে যাওয়ারই কথা। যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মোদির এত নির্ভরতা, সেই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারতের বন্ধুপ্রতিম একটি দেশও এখন পর্যন্ত চীনের এই হামলায় ভারতের পক্ষ নিয়ে একটি কথাও বলেনি।

৪ জুন মোদি সামরিক কৌশল নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সঙ্গে যে ভার্চু্যয়াল বৈঠক করেছেন এবং বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, তার কোথাও লাদাখের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কথাও ছিল না। চীনের সঙ্গে যখন পুরোদস্তুর লড়াই লেগে গেছে, তখন ভারতকে সমর্থন করার মতো একটি দেশও নেই। বিশিষ্ট এশিয়া বিশেষজ্ঞ স্টিফেন রোস সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অচিরেই বড় আকারের বাজেট ঘাটতি দেখা দেবে এবং তার ফলে ডলারের মূল্যপতন শুরু হয়ে যাবে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতায় যেতে চাইছে। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের পরই সে ধরনের চুক্তি হতে পারে।

মোদি আশা করেছিলেন, করোনা–পরবর্তী আমলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বদলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তখন চীন থেকে মুখ ঘুরিয়ে ভারতকে সরবরাহকারী অংশীদার হিসেবে চাইবে। এসব দেশ তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে ভারতে নিয়ে আসবে। কিন্তু এসব আর সম্ভব হবে না। চীন এখন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টায় আছে। ভারতের সঙ্গে চীনের ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটারের সীমান্ত থাকায় চীন মনে করে, এই অঞ্চলে ভারতের সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি তাকে হিমালয় ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমস্যায় ফেলবে।

সি চিন পিংয়ের সঙ্গে মোদির যে বৈঠক হয়েছিল, তাতে একটি সমঝোতা হয়। সেখানে উভয় দেশ উভয়ের স্পর্শকাতর বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে বলে বলা হয়েছে। চীন মনে করছে, মোদি সরকার সি চি পিংকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে পশ্চিমাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। সম্প্রতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, আকসাই চীনকে আবার চীনের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। এতে তাদের সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়। চীন এখন ভারতকে এই বার্তা দিতে চায়, যদি পশ্চিমাদের সঙ্গ ছেড়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে দিল্লি থাকে তো ভালো, না থাকলে ১৯৬২ সালের চেয়ে করুণ পরিণতি ভারতকে ভোগ করতে হবে। এই সংকট যদি মোদি আলোচনা দিয়ে কাটিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে সত্যিই ভারতকে শক্ত সাজা দেবে চীন।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
ভিম বুরতেল: নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিষয়ের অধ্যাপক