টিকে থাকার জন্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যা করতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যারাই এই করোনাকালে বাসা থেকে কাজ করেছেন, করছেন কিংবা দেশে-বিদেশে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন, তাঁরা সবাই একটি নতুন বাস্তবতা বা ‘নিউ নর্মালের’ সঙ্গে পরিচিত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে কাজ করতে গেলে আরও অনেক দিন এই ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ বা ঘরে থেকে কাজের ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। এতে নতুন নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তি সমাধান শিখতে হবে বা তার সঙ্গে মানিয়েও নিতে হবে। এই ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ আমাদের জীবনাচরণেও অনেক পরিবর্তন এনেছে এবং আনবে।

নগরের যানজট, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ভোরে তাড়াহুড়ো করে অফিসের প্রস্তুতি, দেরি করে বাড়ি ফেরা, বাচ্চাদের বা মা–বাবার সঙ্গে প্রায় দেখা না হওয়ার অবস্থা পাল্টেছে এবং আরও পাল্টাবে। এমনকি হয়তো নিয়মিত প্রার্থনা বা শরীরচর্চার অভ্যাসও গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে রান্নাঘরে বা ঘরের কাজে জীবনসঙ্গীকে সহায়তা করার অভ্যাস। এমনকি কাজের ফাঁকে একটু চোখ বুজে নিলেও কোনো সমস্যা নেই। হয়তো অভ্যাস গড়ে উঠবে সবাইকে নিয়ে ছবি বা নাটক দেখার বা গান শোনার। অনেকে ঢাকার বাইরে থেকেও কাজ করতে পারবেন। অনলাইন ক্লাসের সুযোগে বাচ্চারাও প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হতে পারবে।

ইতিমধ্যে ব্যক্তি ব্যাংকিংয়ে আমরা প্রায় সবাই অনলাইন ব্যাংকিং বা অলটারনেট ব্যাংকিং (ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এটিএম, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা পস মেশিন) তথা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছি। মোবাইল ব্যাংকিং তো ইতিমধ্যে অনেক জনপ্রিয়। ভবিষ্যতে অনলাইনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ আরও কাজ বা ট্রানজেকশনও সম্পন্ন করা যাবে। এ কাজে হয়তো নিয়ন্ত্রক সংস্থাও আরও তৎপর হবেন। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে ব্যাংকগুলো আরও বিনিয়োগ করবে। নগরীর দামি দামি জায়গায় অবস্থিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাগুলো তুলে দিতে পারলে অনেক খরচেরও সাশ্রয় হবে।

এমনকি ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ ব্যবস্থায় আরও বেশি কর্মীকে রাখতে পারলে অফিসেও জায়গার প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে এবং ভাড়া বাবদ অনেক টাকার সাশ্রয় হবে। কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেটের খরচ কমবে। তার প্রভাবে ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনগত খরচও কমবে। কর্মকর্তাদের অনেকেই পালা করে বাড়িতে বসে কাজ করতে পারবেন বলে তাঁদের জীবনমান এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

অন্যান্য দেশে আপৎকালে বেঁচে থাকার প্রধান উপায় খরচ কমানো। সবাই যে শুধু কর্মী ছাঁটাই করে খরচ কমায় তা নয়। আমার পরিচিত একটি বহুজাতিক কোম্পানি-তাদের দক্ষিণ এশিয়ায় ৪০০ জনের মতো সিনিয়র, যাঁরা পার্টনার বা এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, তাঁদের সুযোগ-সুবিধা ২৫ শতাংশ কমিয়েছে, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের জন্য অভ্যন্তরীণ বিদেশভ্রমণ এবং হোটেলে থাকা বাদ দিয়েছে। ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো লোক ‘ওয়ার্কিং ফ্রম হোম’ করবেন বলে অফিস ভাড়া, যাতায়াত এবং চা-নাশতার খরচ অনেক কমে আসবে। এতে যদি সেই কোম্পানি দুর্দিনে বছরে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা বাঁচিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে তো ছোট বা মধ্যমদের ছাঁটাইয়েরও প্রয়োজন নেই। অবশ্যই তাদের অনেক অনেক যাচাই-বাছাই না করে নতুন লোক নিয়োগ থেকে বিরত থাকতে এবং দুর্দিনে গ্রাহকসেবা বা ব্যবসা উন্নয়নে সক্ষম বা দক্ষ লোকদেরই বেশি দেখভাল করতে হবে। কেউ যদি তাদের ছেড়ে যায়, তার জায়গায় অন্তর্বর্তীকালে কোনো লোক নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এভাবেই বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে হয়, আমাদেরও একই ধারায় টিকে থাকতে হবে। ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানকে বাহুল্য খরচ না কমিয়ে উপায় নেই। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও প্রশাসনিক খরচ কমানোর কথা ভাবতে হবে। আউটসোর্সিংয়ের কথা ভাবতে হবে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লোক থাকলে হয়তো কমানোর দরকার হতে পারে। অনেকটা সক্রেটিসের ‘হাউ মেনি থিংস আই অর উই ক্যান ডু উইদাউট’। এ ক্ষেত্রে এক্সপেন্স অপটিমাইজেশন বা বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং পশ্চিমা বিশ্বে একটি বহুল পরিচিত বিষয়। বাংলাদেশে হয়তো ছিল না, তবে ক্রমাগত বিশ্বায়নের ফলে আজ সেই প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে।

আগেই বলেছি, পরিচালনগত খরচ কমানোর বিকল্প নেই। নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জুনিয়রদের বাঁচিয়ে রাখতে সিনিয়রদের ত্যাগ স্বীকার বা সেক্রিফাইস করতে হবে। তবে ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান যদি সরকার থেকে কোনো সাহায্য বা প্রণোদনা নিয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য দেশের মতো হয়তো সরকারের কথা মেনেই ছাঁটাই করতে পারবে না। কোনো সাহায্য না নিয়ে থাকলে বাধ্যবাধকতাও থাকবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা অন্যান্য দেশের মতো সরকার চাইলে যেকোনো ব্যক্তিকে নগদ বা ত্রাণ সহায়তা দিতেই পারে। তাঁরা চাকরিচ্যুত হোন আর না-ই হোন।

আমাদের মুরব্বিরা একটি কথা প্রায়ই বলেন—জিততে হয় কেনায়। তাই আপৎকালে সব পুরোনো বা চলমান ক্রয়চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আউটসোর্সিং বা শেয়ার্ড সার্ভিসের কথা ভাবতেই হবে। খরচ বাঁচানোর নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতেই হবে।

আমরা জানি, কর্মচ্যুতির হার বাড়লে বা বেকারের সংখ্যা বাড়লে বিরাট হাহাকার লেগে যেতে পারে। সামাজিক সমস্যাও হবে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের সময় যদি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কিংবা সরকার যদি আইনানুযায়ী নজরদারি করে, তাহলে এই সমস্যা অনেক কমে আসতে পারে। কোম্পানি যদি গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা সেপারেশন বেনিফিট ঠিক সময়ে পরিশোধ করে, তবে এই টাকা কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন উদ্যোক্তারাও জন্ম হতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশে হোম ডেলিভারি, লজিস্টিকস এবং সস্তায় মানসম্মত খাবারের ব্যবসার নতুন করে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে এবং আরও দেখা দেবে।

তবে প্রতিষ্ঠানকে আরও সক্ষম, দক্ষ ও ব্যয়সাশ্রয়ী করতে প্রথমে পরিচালনগত ব্যয়ের প্রতিটি হেড বা আইটেম ধরে ধরে নিরীক্ষণ, সব সম্ভাব্য ব্যয় হ্রাস, বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, ভ্রমণ আয়োজকদের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করে খরচ কমানো, আপ্যায়ন ব্যয় কমানো, তারপর একটি পর্যায়ের ওপর সিনিয়রদের বেতন হ্রাস। জুনিয়রদের বেতন হ্রাস বা ছাঁটাই হবে সর্বশেষ পর্যায়। সেই সঙ্গে কর্মীদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিতেও বিশেষ করে নজর দিতে হবে। অনেক বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি তাদের রিডানডেন্ট বা সাময়িক প্রয়োজনাতিরিক্ত লোকের জন্য বাজারে কাজ খুঁজে পাওয়ার সুবিধার্থে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে অনেক বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বছরের পর বছর মোটা অঙ্কের মুনাফা করেছে, তারা পর্যন্ত বেতন-ভাতা কমাচ্ছে, এমনকি কর্মচ্যুতির কথাও বলেছে বা ভেবেছে হয়তো করোনায় আক্রান্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই। এটি গ্রহণযোগ্য নয়, বিশেষ করে তারা যদি কোনো সরকারি সুযোগ নিয়ে থাকে। তা না হলে তাদের সব পদ্ধতি বা আইন মেনেই কাজ করতে হবে। তা ছাড়া ভালো প্রতিষ্ঠান কখনোই ভালো কর্মীকে হারানো উচিত নয়। দক্ষ ও গ্রাহক-নিবেদিত জনশক্তি আজকের দিনে ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ। তাই অবিরাম গ্রাহকসেবা নিশ্চিতের জন্যও প্রশিক্ষিত ভালো কর্মী দরকার। এখানে নেতৃত্বও একটি বিরাট বিষয়।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনার কারণে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ও প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক অনেক বেড়েছে। এতে অফিস স্পেস ও ব্যয় হ্রাস করার কথাও বলছেন অনেকে। তাহলে প্রশ্ন আসে, আমরা কি এত দিন সম্পদের অপচয় করে আসছিলাম? উত্তর অনেকটা সোজা—অবশ্যই। প্রযুক্তির সহায়তায় বিকল্প পদ্ধতিতে কাজের মাধ্যমে ব্যয় হ্রাসের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই ঢাকায় কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেটের দাম অনেক বেশি বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন। অধিকসংখ্যক লোক বাসায় থেকে কাজ করতে পারলে বা প্রযুক্তি-সহায়তা থাকলে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, আগ্রাবাদে বড় বড় বাড়ি বা অট্টালিকায় অতিরিক্ত ভাড়ায় ব্যাংক শাখার কোনো প্রয়োজন নেই, এগুলো হয়তো হবে স্টারবাকস বা ম্যাকডোনাল্ডের শাখা। এমনিতেই বাংলাদেশে করপোরেট গ্রাহকেরা শাখায় আসেন না এবং বেশির ভাগ ব্যাংকই সত্যিকারের রিটেইল ব্যাংকিং বা ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট করে না। রিটেইল ব্যাংকিংয়ের নামে যা করে, তা সহজেই অলটারনেট ব্যাংকিং বা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করা সম্ভব।

সন্দেহ নেই, ভবিষ্যতের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক অনেক বাড়বে। করোনা যদি আরও বেশ কিছু সময় ধরে থাকে, তবে বাণিজ্যের ব্যয় বেড়ে উঠবে নিরাপত্তা উপকরণ নিশ্চিত করতে। এ ব্যয় সামাল দিতে মনে রাখতে হবে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আবার সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়বে। তবে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই প্রযুক্তি ব্যয় কমে আসবে। এতে নিরাপত্তাসহ নতুন বিনিয়োগও সম্ভব হবে।

করোনার প্রভাব যদি আরও অনেক দিন চলতে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নতুন নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া, মুনাফা এবং ভালো কর্মীদের ধরে রাখতে পারার চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন এসেছে, অনানুষ্ঠানিক খাতে কি ধরনের প্রভাব দেখতে পারি আমরা? আমরা জানি, দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ এখানে কাজ করে। যেখানে হোটেলশ্রমিক থেকে শুরু করে অনেকেই আছেন। অনেকের মতেই অনানুষ্ঠানিক খাতে সরকারি সহায়তার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে এ কাজে এনজিও, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, এমনকি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।

আমাকে তরুণেরা প্রশ্ন করছেন, করোনা–পরবর্তী কোম্পানির মুনাফায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে? এমনকি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কী ধরনের পরিবর্তন আপনি প্রত্যাশা করছেন কিংবা ভবিষ্যতে টিকে থাকতে হলে কী কী করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে? সোজা উত্তর, খরচ কমাতে না পারলে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অভিনবত্ব না আনতে পারলে বেশির ভাগ কোম্পানিরই মুনাফা কমে যাবে। হয়তো টেকনোলজি, সুপারশপ বা অর্গানাইজড রিটেইল, মোবাইল অপারেটর বিশেষ করে ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এর ব্যতিক্রম হবে। অন্যদিকে, পরিচালনগত খরচ কমাতে পারলে, ভালো কর্মীদের ধরে রাখতে পারলে, ব্যবসার মডেল পরিবর্তন করতে পারলে ভবিষ্যতে অনেকের মুনাফা বাড়বেও।

মোদ্দা কথায় করোনার মাঝে বা পরবর্তীকালে টিকে থাকতে হলে বা নব-উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হতে হবে খরচ কমানো এবং খরচ কমানো, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যবসায়ের মডেল পরিবর্তন এবং ঊর্ধ্বতনদের নেতৃত্বের প্রমাণ।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক।