কামাল লোহানী: নামই যাঁর বড় পরিচয়

কামাল লোহানী
কামাল লোহানী

কামাল লোহানীর সঙ্গে সরাসরি পরিচয় ও আলাপচারিতা আগরতলায়, দুই দশক আগে। তার আগে সংবাদকর্মী হিসেবে ঢাকায় উনার প্রচুর অনুষ্ঠান কভার করেছি। কিন্তু সরাসরি কথাবার্তা ছিল শুভেচ্ছা বিনিময় পর্যন্ত। আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে গিয়ে উনার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাটা পোক্ত হয়, যা দিনে দিনে বেড়েছে।

আগরতলা বললেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওই স্থানে শ্রদ্ধেয় মানুষটির সঙ্গে সামনাসামনি আলাপচারিতা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে সংবাদকর্মী হিসেবে সেখানে গিয়েছিলাম। সময়টা ২০০১ সালের ১১ থেকে ১৩ জুন। অনুষ্ঠানটি ছিল আগরতলা-ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ উৎসব। পরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা-আগরতলা মুক্তিযুদ্ধ উৎসব। যদিও সেটা তেমন জাঁকজমকপূর্ণ হয়নি নানা কারণে।

একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে সেদিনের স্মৃতি আজও ভাসে চোখের সামনে। ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে ধারণা পাই ব্যক্তি কামাল লোহানী সম্পর্কে। তিনি ছিলেন উৎসব কমিটির আহ্বায়ক। তাঁর নেতৃত্ব, ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। সুঠাম ও দীর্ঘাঙ্গী মানুষটি সম্পর্কে সেই যে ভালো ধারণা, তা আজও অমলিন।

মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে যোগ দিয়ে আরেকজন মানুষকে চিনতে পারি, তিনি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেদিন ত্রিপুরার অনেক মানুষকে দেখেছিলাম উনাকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে। একজন নারীর কথা মনে পড়ে, যিনি এসে পরিচয় দিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. চৌধুরীকে রান্না করে খাইয়েছেন। নারীর মাথায় হাত রেখে তাঁকে চিনতে পারলেন ডা. জাফরুল্লাহ। আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে একটি আনারসবাগানে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’।

মুক্তিযুদ্ধ উৎসবে গিয়ে কামাল লোহানী এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি সেই যে ভক্তি-শ্রদ্ধা, তা ধীরে ধীরে বেড়েছে। ওই অনুষ্ঠান ছিল সত্যিই ব্যতিক্রমধর্মী। শখানেক লোক যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে সংখ্যাটা কয়েক শ হয়ে যায়। আগরতলায় যেতে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিনিধিদলের কয়েকজনের কথা মনে পড়েছে—রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আ স ম আবদুর রব, মীর শওকত আলী, হাবিবুল আলম, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, হারুন হাবীব, মেসবাহ কামাল, হাসান আরিফ প্রমুখের নাম।

ওই উৎসব থেকে ফেরার পর লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে বা ফোনে প্রথমেই বলতাম, ওই যে আপনার সঙ্গে আগরতলা উৎসবে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, উনি আমাকে মনে রাখতে পারেন না। এ জন্য দেখা বা কথা হলেই আগে ওই উৎসবের কথা বলতাম। ওই সময়ে আমার কর্মস্থল জনকণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধ উৎসবের খবর দেখে তিনি খুশি হয়েছিলেন। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম, উনি আমাকে চিনে ফেলেছেন।

গত ১৭ মে থেকে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কামাল লোহানী। হাসপাতালটির চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরীর কাছ থেকে মাঝেমধ্যে শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতাম। গত কয়েক দিনে অবস্থার অবনতি, হাসপাতাল বদল, কোভিড–১৯ পজিটিভ হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত চলে যাওয়া। মনে মনে ভাবছিলাম, এক যোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফিরে এসেছেন, কামাল লোহানীও ফিরে আসবেন। কিন্তু সব চাওয়া কি আর পূরণ হয়? চলে গেলেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সেই কৃতী সন্তান আবু নাইম মোহা. মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালে জন্ম, বয়স হয়েছিল ৮৬।

শনিবার সকালে সাগর লোহানী ভাইয়ের কাছ থেকে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে ভাবছিলাম, কামাল লোহানীর পরিচয় কী দেব? যদিও নামই উনার পরিচয়। তারপরও একটি বিশেষণ তো দিতেই হয়। মানুষটির এত বেশি পরিচয় যে একটি বেছে নেওয়া কঠিন। শেষমেশ ভাবলাম, উনার ক্ষেত্রে সংগ্রামী কথাটাই হয়তো জুতসই। উনার যে বর্ণাঢ্য জীবন, তাতে চিরসংগ্রামী ছাড়া আর কোনো বিশেষ পরিচয়ে উনাকে আটকাতে পারছিলাম না।

লিখতে বসে ভাবছিলাম, উনি ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা—এর চেয়ে বড় পরিচয় তো আর নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে উনি একজন সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। সংস্কৃতির মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও সুস্থ সমাজ গড়ার স্বপ্ন লালন করেছেন জীবনভর। ছায়ানট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মতো প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে তখন গান গেয়েছেন আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ প্রথিতযশা শিল্পীরা।

রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা—সব ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছেন কামাল লোহানী। মাঠে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন, আবার কলমযোদ্ধাও ছিলেন। আজীবন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অবিচল ছিলেন। বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ ও দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তিনি তখন একজন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী। স্বাধীনতার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথমসারির যোদ্ধা ছিলেন তিনি।

ছাত্রজীবন থেকেই সংগ্রাম-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কামাল লোহানী ও তাঁর অন্য সহযোদ্ধারা গ্রেপ্তার হন। তাঁর বয়স তখন ১৯, মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন।

মানুষটি সাংবাদিকতা করেছেন। দৈনিক মিল্লাত দিয়ে সাংবাদিকতার শুরু, এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।

কামাল লোহানীর মতো নাগরিকের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই প্রজন্মের সামনে সংগ্রামী, সৎ, মেধাবী, সুবিবেচক ও সাহসী নাগরিক খুব একটা নেই। আমরা মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছি না তো? ইদানীং এই প্রশ্ন তাড়া করে নিজেকে।

শরিফুজ্জামান, সাংবাদিক
pintu.dhaka@gmail,com