অস্থিরতার মুখে পড়তে পারে উপমহাদেশ

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

জুন ১৫–১৬; রাতে হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম প্রান্তে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট ওপরে লাদাখ তথা আকসাই চীনের লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলে (এলএসি) ভারত–চীনের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, তাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভারতীয়রা এলএসি–সংলগ্ন গালওয়ান ভ্যালিতে চীনা সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের ১৬ বিহার রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল সন্তোষ বাবুসহ ২০ সেনা নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে অনেকে। খরস্রোতা গালওয়ান নদে কিছু সৈন্য ভেসে গেছে বলে ভারত জানিয়েছে। অনেক সৈনিককে পাওয়া যাচ্ছে না, হয়তো চীনের কাছে আটক রয়েছে। এর মধ্যেই ভারতীয় সূত্র বলেছে যে চীনের প্রায় ৪৩ জন সৈনিক হতাহত হয়েছে, যদিও এর নিরপেক্ষ কোনো প্রমাণ মেলেনি। লাদাখের আকসাই চীনসহ এই সীমান্ত ৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ। ১৯৬২ সালে আকসাই চীন দখলের পর দুপক্ষই এই অস্থায়ী লাইন মেনে নিয়েছিল।

ভারত মধ্য চীনের অনেকগুলো সীমান্ত চুক্তিতে গোলাগুলি না করার শর্ত থাকার কারণে এ ঘটনায় কোনো পক্ষই অস্ত্র ব্যবহার করেনি। এরপরও এত প্রাণহানি কীভাবে হলো, তা নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। ভারত–চীন সীমান্তে এমন হতাহতের ঘটনা গত ৫০ বছরে ঘটেনি। চীনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য ভারতীয় সেনাদের বিশৃঙ্খলা ও অসামরিক আচরণকে দায়ী করে ভবিষ্যতে এলাকায় উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টার কথা বলেছে। একই সঙ্গে চীন দাবি করেছে, যে অঞ্চলে এ ঘটনা ঘটেছে, সেই গালওয়ান উপত্যকা চীনের নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের অন্তর্ভুক্ত। চীনের এই দাবি ভারতের তো মানার কোনো কারণ নেই। কিন্তু চীন ওই অঞ্চলে সেনাবাহিনী বাড়িয়েছে এবং প্রচলিত সমরাস্ত্রও জড়ো করেছে বলে ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে।

চীন শুধু গালওয়ান উপত্যকাই নয়; পানগং হ্রদের ওপরের উচ্চভূমির বেশির ভাগ দখল নিয়েছে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, সেখানেই ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার এলাকা চীনের দখলে। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দখল করা জায়গা চীন যদি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়, তা ফিরে পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে পাল্টা শক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নেওয়া। ভারত সেই পথে হাঁটবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুখে যা–ই বলুন, তিনি এবং তাঁর উপদেষ্টারা ভালো করেই জানেন, চীন পাকিস্তান নয়। ভারত কোনো ধরনের আগ্রাসনে গেলে তা চীনের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে হাজির হবে। সে রকম পরিস্থিতিতে চীন-ভারত সংঘর্ষ শুধু লাদাখ নয়, বরং পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে অরুণাচল ও সিকিমের দিকেও ছড়িয়ে পড়বে। ভারতের পক্ষে ওই ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিকভাবে চাপের মধ্যে রয়েছেন। সর্বদলীয় বৈঠকের পরেও চাপ কমছে বলে মনে হয় না।

চীন–ভারত যেকোনো সংঘর্ষের প্রভাব কাশ্মীরের ওপর গিয়েও পড়বে। কাশ্মীরে কথিত সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের সামরিক শক্তিও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের গিলগিত, বাল্টিস্তান এবং কারাকোরাম হাইওয়ে চীন ও পাকিস্তান দুই দেশের জন্যই (এই সড়ক চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত) ভূকৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। 

এই সংঘাতের কারণ নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হচ্ছে। আমার মতে, কৌশলগত ও ভূকৌশলগত—এই দুই বিবেচনায় ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করা যায়। ভারত দুই বছর ধরে ২৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাকা রাস্তা গালওয়ান ও সায়খ নদের পশ্চিম তীর ঘেঁষে তৈরি করেছে। এই রাস্তা দৌলত বেগ ওলি নামক প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে দোই উপত্যকায় স্থাপিত বিমানঘাঁটিকে যুক্ত করেছে। চীন বিমানঘাঁটি এবং সেখানে সৈন্য সমাবেশসহ রাস্তা ও অন্যান্য সামরিক অবকাঠোমো নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছে। ভারত তা মানেনি। চীনের দাবি, এই রাস্তা এলএসির খুব কাছে এবং দৌলত বেগ স্থাপনা চীনের সীমান্তের কাছাকাছি। উল্লেখ্য, তিব্বত সিনডিয়াং হাইওয়ে, যা রোড বেল্টের অংশ কারাকোরাম গিরিপথ দিয়ে গেছে। আর এই গিরিপথ দৌলত বেগের কাছাকাছি। সামরিক পরিভাষায় ‘ডমিনেটিং গ্রাউন্ড’। এ ছাড়া ভারত গালওয়ান উপত্যকার সায়খ নদে পুল নির্মাণের উদ্যোগ নিলে উত্তেজনা শুরু হয়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষে হাতাহাতি হয়। পরে উত্তেজনা প্রশমনের কথা থাকলেও ভারতীয়দের মতে, চীন সরে আসেনি। চীন ওই অঞ্চল দখলে রেখেছে। তার মানে দৌলত বেগের রাস্তা চীন যেকোনো সময় ছিন্ন করতে পারে।

তা ছাড়া দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এখানে ভূমিকা পালন করেছে। বছরখানেক আগে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রাণের বিনিময়ে পাক কাশ্মীর, গিলগিত, বাল্টিস্তানসহ আকসাই চীন দখল করার দম্ভোক্তি করেছিলেন। চীনের পক্ষে এই হুমকিকে ভালোভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং কাশ্মীর আর লাদাখ অঞ্চলকে আলাদা করে ইউনিয়ন টেরিটরি ঘোষণাও চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। 

মোদি সরকার বর্তমানে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকেছে, তাতে চীন স্বস্তিতে নেই। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরায়েলের এবং পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ভারত যেভাবে ঝুঁকে পড়ছে, তাতে চীন ভারতকে চীনবিরোধী জোটের অগ্রসৈনিক ভাবছে। এরই মধ্য ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্মিলিত নৌমহড়ায় অংশ নেয়, যা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত এই মহড়ার পর চীন ভারতের ব্যাপারে আরও সতর্ক হয়। তদুপরি ভারত–যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে ভারতীয় উত্তরাঞ্চলের বিমানঘাঁটিতে যৌথ মহড়াও করেছে। সর্বশেষ কয়েক সপ্তাহ আগে ভারত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিউচুয়াল লজিস্টিক সাপোর্ট অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। এর আওতায় দুই দেশ তাদের নৌবাহিনীর ঘাঁটি বিভিন্ন সামরিক কারণে ব্যবহার করতে পারবে। অস্ট্রেলিয়াও চীনবিরোধী ক্যাম্পে রয়েছে। কোভিড-১৯ ছড়ানোর দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চীনের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে। 

দৃশ্যত চীন বৃহত্তর আঙ্গিকে ভারতকে ভূরাজনৈতিকভাবে ঘিরে ফেলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। নেপাল ভারতের বলয় থেকে বের হয়ে চীনের বলয়ে ঢুকে পড়েছে। এটা ভারতের জন্য এ সময় নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে চীন-ভারত যেকোনো সীমান্ত সংঘর্ষে, বিশেষ করে নামুলা গিরিপথ অঞ্চলে নেপাল বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই এসব বিষয় মাথায় রেখেছেন।

চীন-ভারত এই টানাপোড়েন সহজে শেষ হবে বলে মনে হয় না। ভারতের অতি জাতীয়তাবাদী সরকার রাজনৈতিক ও জনগণের চাপ প্রশমনে কী পদ্ধতি গ্রহণ করবে, তা নিকট ভবিষ্যৎ বলবে। তবে ভারতের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই। কূটনীতির মাধ্যমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা মানে ভারতের ভূমি চীনের দখলে থেকে যাওয়া। মোদি সরকারের জন্য তা ভালো হবে না।

অন্য পথ হলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা। ইতিমধ্যে চীনা পণ্য বর্জনের আওয়াজ উঠেছে। সরকার ভারতের টেলিকম কোম্পানিগুলোকে চীনের চারটি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার নির্দেশ দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। টেলিকম খাতের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এমনকি চীনা কোম্পানির যেসব মেগা প্রকল্প কাজ শুরুর পথে, সেখানেও নিষেধাজ্ঞার চিন্তাভাবনা চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ ধরনের উদ্যোগ ভারতের অনুকূলে যাবে কি না, তা পরিষ্কার নয়। ভারতের অর্থনীতি এত বড় চাপ সহ্য করতে পারবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন। 

শেষ অস্ত্র সামরিক শক্তির ব্যবহার। ভারত এই শক্তি ব্যবহার করলে চীনের হাতে তুরুপের তাস তুলে দেবে। সে ক্ষেত্রে চীন ভারতের পূর্বাঞ্চলেও তৎপরতা চালাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৬২ সালে ঘেরাও হওয়ার আশঙ্কায় চীন পূর্বাঞ্চল দখল করেও সৈন্য প্রত্যাহার করেছিল। এবার হয়তো তেমন হবে না, কারণ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হুমকিতে থাকবে ভারতের পূর্বাংশের সঙ্গে যোগাযোগের পথ শিলিগুড়ি করিডর।

যেকোনো সামরিক সংঘাত চীন-ভারতের সমস্যা সমাধান করবে না, বরং উপমহাদেশকে আগুনের ভান্ডারে পরিণত করবে। জড়িয়ে পড়তে পারে পাকিস্তান ও নেপাল। চীন-ভারত উভয়েই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীন বাংলাদেশের উন্নয়নের শক্তিশালী সহযোগী। অন্যদিকে ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী, কাজেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে, তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে।

চীন-ভারত সামরিক সংঘর্ষ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করি, এ অঞ্চলের অগ্রগতি ও শান্তির জন্য দুপক্ষই উসকানিমূলক কিছু করা থেকে বিরত থাকবে এবং আলোচনার মাধ্যমে ‘উইন উইন’ পরিবেশ তৈরি করে সমস্যার সমাধান করবে। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)