খাদ্য ও চিকিৎসা বাদ দিয়ে উন্নয়ন?

‘গতানুগতিকভাবেই সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ এবারের বাজেটকে গতানুগতিক বলেছে’—বাজেট নিয়ে সিপিডির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দেশের এক গণমাধ্যমকর্মীর মন্তব্য এটি। অনেকেই আশা করেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় ভিন্ন ধরনের বাজেট হতে পারে এবার। কিছু অঙ্কের হিসাব, উন্নয়নের স্বপ্ন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে অন্যবারের মতোই। উন্নয়নের গালভরা নানা গল্প বলা আছে এতে। দেশের বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞ ‘উচ্চাভিলাষী’, ‘বাস্তবায়নযোগ্য না’, ‘কর বাড়বে’—এই ধরনের কিছু মুখস্থ কথার সঙ্গে কিছু দুর্বোধ্য হিসাব–নিকাশের ঘোরপ্যাঁচ মিশিয়ে গৎবাঁধা সমালোচনা করেছেন। এতে দুই কুলই রক্ষা হয়। মৃদু সমালোচনাও হলো। আবার বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের সমীক্ষার দায়িত্বও পাওয়া যায়। কিন্তু এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি, উন্নয়নের সুফল সাধারণের ঘরে পৌঁছায় না। চুরি ও লুটপাটের চোরাবালিতে হারিয়ে যায় উন্নয়নের ত্রাণ। 


করোনায় এমনিতেই দেশের মানুষ আর্থিক চাপে আছে। প্রত্যাশা ছিল বাজেটে বিশেষ ঘোষণা থাকতে পারে। তা হতে পারে করোনা চিকিৎসা বিনা মূল্যে করে দেওয়া। বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করা। বাড়িভাড়ায় সহায়তা করা। নগদ আর্থিক সহায়তা। মধ্যম বা উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে নাগরিকেরা এসব আশা করতেই পারে। এ ধরনের কোনো ঘোষণা তো আসেইনি, বরং ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল এখন দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসে আছে। সেই বিল আবার জুনের মধ্যে পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকিও দিয়ে রেখেছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়।

বাজেটে প্রণোদনা ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি আছে বটে কিন্তু আশ্বস্ত হওয়ার মতো না। এক কথায় বাজেট আদৌ গণবান্ধব হয়নি। আগেও যে কখনো হয়েছে তাও না। তবে এবার করোনা মহামারির কারণে কিছু কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে মেগা বা অজরুরি উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, কর্মস্থানে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।

প্রথম কাজ হতে পারত স্বাস্থ্য খাত পুনর্গঠন করা। স্বাস্থ্য খাতকে একেবারে উদোম করে দিয়েছে করোনা মহামারি। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা একেবারেই বেহাল। আইসিইউর জন্য হাহাকার চলছে। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। উচ্চ আদালত পর্যন্ত জানতে চেয়েছেন, দেশে কতগুলো আইসিইউ শয্যা আছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৪ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ২৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। পরিস্থিতির দাবি অনুসারে বরাদ্দ খুব বেশি বাড়েনি। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও কমবেশি এই হারেই বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের জন্য। কিন্তু এই বরাদ্দ ব্যয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেই। বরং থোক বরাদ্দ থেকে হরিলুটের শঙ্কা প্রবল। দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য। এই খাতে ১০৮ গুণ বেশি দাম দিয়ে মেডিকেল সরঞ্জাম কেনার সংবাদও আমরা দেখেছি। জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স আছে বলে জানা নেই। জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা এতই বেহাল যে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী—সবাই করোনার চিকিৎসা নিতে সামরিক হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন। বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে হাসপাতালগুলো আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ জরুরি ছিল। জেলা হাসপাতালগুলোয় কমপক্ষে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য খাতের মতোই কৃষির অবস্থা। কৃষিতে ভর্তুকি বেড়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। শিক্ষা বাজেট টাকার অঙ্কে বেড়েছে। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ ভাগ। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত বন্ধ রয়েছে। করোনা আমাদের বড় ধরনের শিক্ষা দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনা দরকার। করোনাকালে সারা বিশ্বে যখন অনলাইনে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম, আমরা তখনো ব্ল্যাকবোর্ডের আমলে আছি।

এবারের বাজেটের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে করোনা–পরবর্তী নতুন নতুন কর্মসংস্থানের কার্যকর পরিকল্পনা নজরে আসেনি। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির তথ্য অনুসারে করোনার কারণে নতুন করে ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে ৪ কোটি ৮২ লাখ বেকার। তাহলে এখন মোট বেকারের সংখ্যা ৮ কোটি ৮০ লাখের বেশি। এতে করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সানেম ও ব্র্যাকের হিসাবমতে এই সংখ্যা ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তার মানে প্রায় ৭ কোটি মানুষ এখন দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে।

এ অবস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল। নতুন বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে ১৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। এ খাতে মোট বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা জনপ্রশাসন খাতের বরাদ্দ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে কম। বিদায়ী অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের ৫৫ শতাংশ ব্যয় হবে জনপ্রশাসনের জন্য। এই খাতে ব্যয় হ্রাস করে প্রয়োজনে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে সামাজিক নিরাপত্তার খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা দরকার ছিল। কেরালায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। যেকোনো দেশেই সংকটকালে কৃচ্ছ্র সাধন করা হয়। এই অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পরিবহন ব্যয় হ্রাস করে গণপরিবহনে যাতায়াতে উৎসাহ করা দরকার।

এসব না করে বরং এমন সব খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এই মুহূর্তে না করলেও চলত। ২৭ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে শেয়ার অ্যান্ড ইকুইটিতে বিনিয়োগের জন্য। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনেরÿক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াট। সরবরাহ ও সঞ্চালনের ক্ষমতা আছে মাত্র ১৩ হাজার মেগাওয়াটের। বেকার বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে নয় হাজার কেটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুট হয়ে যাচ্ছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাত থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। যদিও ওই সরকারের আমলে এক মেগাওয়াটও উৎপাদন বাড়েনি। এখন বলেকয়ে লুট করা হচ্ছে এবং সেটা জোট সরকারের আমল থেকেও বেশি। এই অবস্থায় নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প স্থগিত রেখে বরং জ্বালানি তেলে মূল্য সমন্বয় করা প্রয়োজন ছিল। এতে কৃষকসহ সবার উপকার হতো।

বাজেটে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই প্যাকেজের আওতায়ÿক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা আদৌ ঋণ পাবেন কি না সন্দেহ রয়েছে। এই খাতের জন্য থাকছে ২০ হাজার কোটি টাকা। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতি–পদ্ধতি অনুসারে ঋণ প্রদান করবে। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিচালনা ব্যয় হচ্ছে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। ৯ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলো কতটা ঋণ দিতে আগ্রহী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়; বরং বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে আর্থিক সংকটের কারণে। এ ছাড়া ব্যাকগুলোর মুদ্রাসংকট বাড়বে। বিগত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত ৭২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। নতুন অর্থবছরের ৮৪ হাজার টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ হ্রাস পাবে। এই অবস্থায় হয় সরকারকে টাকা ছাপাতে হবে অথবা রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অথবা ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এবারই ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় সরকার করতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে কোনো মিরাকল না হলে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকাও অর্জন সম্ভব না। সুতরাং আর্থিক মন্দার দিকে এগিয়ে যাবে দেশ।

মন্দার শঙ্কায় রেখে উদ্ধারের বাজেট না করে তথাকথিত উন্নয়নের বাজেট কেন প্রণয়ন করা হলো? এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার শর্ত পূরণ করেছে। ২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের তালিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ কথার কথা আছে। এর সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। বাংলাদেশকে বেকারত্ব কমাতে হবে। যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ধরে রাখতে হবে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির ধারা। দারিদ্র্যের হার, বেকারত্ব হ্রাস ও প্রবৃদ্ধির হার সংখ্যার মারপ্যাঁচে ফেলে উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নে তো ফাঁকি দেওয়ার কোনো রাস্তা নেই। তাই মেগা প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দৃশ্যত মনে হবে, দেশের অনেক উন্নতি হচ্ছে। দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে আছে। কিন্তু এই মধ্যম উন্নত দেশে পর্যাপ্ত আইসিইউ শয্যার অভাবে দম নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে করোনার রোগী। এবারের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মহামারি আক্রান্ত জাতিকে কার্যত বিনা চিকিৎসায়, অভুক্ত রেখেই তথাকথিত লোক–দেখানো উন্নয়নের পিছু ছুটল দেশ। কারণ, তা না হলে পাছে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সুযোগ ফসকে যায়।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক