স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা কঠিন মনে হচ্ছে কেন?

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোভিড–১৯ মহামারি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে না শিগগির। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাত ধোয়া, মুখে মাস্ক ব্যবহার ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো কিছু আপাতদৃষ্টিতে সহজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই করোনার সংক্রমণ অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা যায়। তবু মানুষ সহজে এগুলো মানছে না কেন? নানা কারণের মধ্যে কিছু প্রণোদনা বা স্বার্থচিন্তার বিষয় আছে এখানে।

এক. এটি অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য সাধারণ সর্দিকাশির চেয়ে বেশি কিছু নয়, যা প্রথম দিকে সরকারের উচ্চ মহল থেকে বলা হয়েছিল। কথাটি ঠিক, কিন্তু যা উপলব্ধিতে আসেনি, তা হলো অন্যান্য সংক্রামক রোগের তুলনায় এ রোগের সংক্রমণ ক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি। ব্যক্তিবিশেষের গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর ঝুঁকি খুব কম হলেও (যথাক্রমে ১৫ ও ৫ শতাংশের কাছাকাছি) সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে বলে মোট মৃত্যু ও হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশি হবে। কাজেই ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঝুঁকির তুলনায় পুরো সমাজের ঝুঁকি অনেক বেশি। কিন্তু মানুষের স্বভাবই হলো সমাজের ঝুঁকির চেয়ে নিজের ঝুঁকিকে বড় করে দেখা।

দুই. বয়োবৃদ্ধদের এ রোগে গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়সকাঠামোয় তরুণ ও যুবকদের অনুপাত বেশি, যাকে আমরা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলি এবং যা আগের সময়ের উচ্চ জন্মহারের প্রেক্ষাপটে ১৯৮০ দশক থেকে শুরু হওয়া সফল জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি থেকে পাওয়া সুফল। করোনার সংক্রমণের দিক থেকে এর ভালো দিক হলো, এ বয়সের মানুষের জন্য এই রোগ হলে হাসপাতালের চিকিৎসার দরকার যেমন কম, মৃত্যুঝুঁকিও তেমনি কম। ফলে মোট সংক্রমণের অনুপাতে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কম হবে। আর খারাপ দিক হলো, জনসংখ্যার এই বেশিসংখ্যক কম বয়সীরাই নিজেদের ঝুঁকি কম মনে করে স্বাস্থ্যবিধি পালনে কম মনোযোগী হবে। প্রতিদিনের স্বাস্থ্য বিভাগের বুলেটিনের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাবে যে অপেক্ষাকৃত কম বয়সের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের সংখ্যা বেশি, কিন্তু বেশি বয়সের রোগীদের সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। সারা দেশের পুরো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে এ বিষয় আরও প্রকট আকারের বলে মনে হতো। এ ক্ষেত্রেও বেশির ভাগ বাইরে ঘোরাঘুরি করা মানুষের বেলায় ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও গোটা সমাজের ঝুঁকির মধ্যে ফারাক তৈরি হয়েছে।

তিন. স্বাস্থ্যবিধিগুলো নিজের প্রয়োজনে যেমন মানা দরকার, অন্যের সুরক্ষার জন্যও তেমনি, এমনকি বেশি মানা দরকার। বিশেষত, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের মানুষ, যাদের এ রোগ হলেও মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি কম বা সংক্রামিত হলেও যাদের উপসর্গ কম বা নেই, অন্যদের প্রতি বিবেচনা থেকেই বরং তাদের স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ থেকে সমাজের কল্যাণকে যে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, তা তো পরিষ্কার।

সামাজিক আচরণে পরিবর্তন আনা সহজ নয়। বাংলাদেশে এর আগে সামাজিক সচেতনতা বাড়িয়ে বড় বড় সাফল্য এসেছে। যেমন: আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ, শিশুদের টিকা দেওয়া বা খাবার স্যালাইন দিয়ে উদরাময়ের চিকিৎসা। এসবের ফলে সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোয় অনেক অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু নিজের বা পরিবারের স্বার্থই বড় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। তা না হলে শিশুবিবাহ বা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলো না কেন? তা ছাড়া আচরণে পরিবর্তন আনতে সময়ও লেগেছে।

এসব বিবেচনায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে অনেক বড় ধরনের সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি এবং সেই সঙ্গে কিছু বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগও প্রয়োজন হবে। অনেক সমস্যা তো আছেই, জীবিকার তাগিদ, জনসংখ্যার চরম ঘনত্ব। প্রসঙ্গত, এক বিদেশি সাংবাদিক প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে মন্তব্য করেছিলেন: এটি একমাত্র দেশ, যেখানে ঘরের বাইরে এমন কোনো খোলা জায়গা নেই, যেখানে অন্য আরেকজন মানুষকে দেখা যাবে না। এই অবস্থায় শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা কি সহজ কথা! যেসব কর্মসূচির কথাই আমরা বলি না কেন, সবকিছুর মধ্যেই মানবিক বিবেচনা ও বাস্তবতার চিন্তা থাকতে হবে।

ইতিমধ্যে কিছু কিছু অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে নেওয়া পদক্ষেপগুলো জনসচেতনতা তৈরিতে কিছুটা হলেও কার্যকর হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। যেভাবে দেশব্যাপী সংক্রমণের বিস্তার ঘটছে, মনে হচ্ছে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রধান সেনাপতির নির্দেশে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধ নয়, বরং স্থানীয় পর্যায়ে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে, যেমনটি সফলতার সঙ্গে করেছে ভারতের কেরালা রাজ্য তাদের শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে। এই শেষের কথাটি আমার নয়, অমর্ত্য সেনের।