মা, তুমি ভালো থেকো

জোহরা বেগম। ছবি: সংগৃহীত
জোহরা বেগম। ছবি: সংগৃহীত

মা ঘর থেকে বের হন না, তারপরও চট্টগ্রামের নিজের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন ১৩ জুনের দিকে। আমার বোন আর ভাই ডাক্তার। আমি নিজে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে থাকলেও নিশ্চিন্তে থাকি এই ভেবে যে বোন আর ভাই মাকে সুস্থ করে তুলবে। মায়ের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকল। একসময় পারিবারিক প্রভাব খাটিয়ে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের আইসিইউতে জায়গা পাওয়া গেল। সেখানকার পরিস্থিতি অপ্রতুল। অনেক কষ্টে করোনা প্রতিরোধে জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় জোগাড় করা গেল। কিন্তু ওষুধ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মায়ের কিডনি অকেজো হয়ে যায়। মায়ের কথায় আবার ফিরে আসব।

প্রবাসজীবনের অনেক সামাজিক আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অন্যতম হচ্ছে ফেলে আসা মা–বাবার জন্য চিন্তা। মা আর মাতৃভূমি এই বিষণ্ন চিন্তায় একধরনের নোঙরের ভূমিকা পালন করে। হোমারের ওডিসিয়াস কিন্তু অনেক ঘোরাঘুরির পরে তার আদিভূমি ইথাকাতেই ফিরে আসে। ঘুরেফিরে আমরাও শেষ পর্যন্ত মা আর মাতৃভূমিতে ফিরি অথবা ফিরতে চাই অথবা ফিরতে না পারার স্বার্থপর অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগি। এসব ভাবতে ভাবতে গ্রেগরি চুখরাইয়ের সোভিয়েত সিনেমা ‘ব্যালাড অব আ সোলজার’–এর (১৯৫৯) কথা মনে হয়ে গেল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র রাশিয়ার তরুণ সৈনিক আলিওশা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তার কমান্ডারের কাছ থেকে একটা পুরস্কার পায়, কিন্তু পুরস্কারের বদলে সে ছয় দিনের একটা ছুটি চাইল, যাতে সে তার গ্রামে গিয়ে মাকে দেখে আসতে পারে। রণক্ষেত্রে একটু বিরতি নিয়ে মাকে দেখতে যাওয়ার এই যাত্রা ছবিটির মানবিক দর্শন ফুটিয়ে তোলে।

আমার মা অসুস্থ। পৃথিবীর ওপর প্রান্ত থেকে ছটফট করছিলাম আলিওশার মতোই কীভাবে মায়ের কাছে ছুটে যাব। বিমানবন্দর বন্ধ। উড়োজাহাজ নেই, মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার সুযোগ নেই, এই অস্থিরতার মধ্যে আলিওশার মায়ের প্রেক্ষাপটে আমার মাকে কল্পনা করছিলাম। যুদ্ধের সময়, সেটা সামরিক যুদ্ধ হোক আর জীবনযুদ্ধই হোক, মা আর মাতৃভূমি প্রায়ই পালন করে অলৌকিক ভূমিকা।

আমার স্মৃতিতে আমার মা আর আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ একটি অভিন্ন বাস্তবতা, একই গল্প, আর আমার নিজস্ব ব্যালাড। তাহলে শুনুন গল্পটা। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে কোনো এক দিনের উজ্জ্বল সকাল। চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাট জনশূন্য আর নিস্তব্ধ। মাঝেমধ্যে শুধু মেশিনগানের শব্দ সন্ত্রাস আর মিলিটারি ট্রাক চলাচলের অস্থির আতঙ্ক। সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনী স্বাধিকার আন্দোলনরত বাঙালির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে এক মাসের বেশি হয়ে গেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই ভূখণ্ডের অসম অর্থনীতি আর অন্যায়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে বাঙালির হৃদয়ে একটি নতুন দেশের স্বপ্ন নিয়ে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না।

আমি ছিলাম ছয় বছরের শিশু। স্মৃতি ধূসর হয়ে গেছে। কিন্তু মে মাসের সেই দিনটি ভুলিনি কখনো। আমাদের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা জনশূন্য। সবাই গ্রামে চলে গেছে আপাত নিরাপত্তার আশায়। শুধু আমরাই আছি আমাদের তিনতলা বাসায়। হঠাৎ সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাসার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করে। ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। তিনতলায় আমাদের খাবার ঘরের টেবিলের নিচে পুরো পরিবার আশ্রয় নিই। আসন্ন মৃত্যুর চিন্তাকে প্রতিরোধের একটা দুর্বল চেষ্টা চলতে থাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে একজন মেজরের নেতৃত্বে একদল সৈন্য দরজা ভেঙে পুরো পরিবারকে বন্দুকের ধাক্কা আর হুংকার দিতে দিতে একতলায় বাড়ির উঠোনে নিয়ে যায়। আমার বাবা আর বড় ভাইদের লাইনে দাঁড়াতে বলে। আমরা বুঝে গেলাম, এটা ছিল তাৎক্ষণিক সামরিক বিচার। ফায়ারিং স্কোয়াড। অভিযোগ, এই বাড়ি থেকে গতকাল কেউ গুলি চালিয়ে একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে আহত করেছে। আমি আর আমার দুই বোন ক্রন্দনরত। আমার মা নির্বাক, অসহায়। মেজর সৈন্যদের সারি করে দাঁড়িয়ে বন্দুক ওঠাতে বলল। মৃত্যু তখন আমার বাবা আর ভাইদের কাছ থেকে পাঁচ সেকেন্ড দূরে।

জীবনমৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে হঠাৎ আমার মা মেজরকে কেঁদে বলল, আমাকে ঘর থেকে একটা জিনিস আনতে সুযোগ দাও। যখন মা হাতে একটা কিছু নিয়ে ফিরে এসে মেজরকে দেখাল, সে বিভ্রান্ত, থতমত হয়ে সৈন্যদের বন্দুক নামাতে আদেশ করল। আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু বুঝেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের পরিবারের একটা নিজস্ব কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে। একজন মহীয়সী মা পরিণত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধায়, হয়েছেন আমাদের পরিবারের নিজস্ব হারকিউলিসে।

এটা নিতান্তই একটা পারিবারিক গল্প। কিন্তু বয়স হওয়ার পরে বুঝেছিলাম এই ছোট্ট ঘটনাটা আসলে মানবতার মহাকাব্য, মানবিকতার কবিতা, যুদ্ধের বিরুদ্ধে মাতৃত্বের বিজয়। আলিওশার মায়ের মতো আমার মাও যুদ্ধের বিপরীতে মানবতার পতাকা তোলার বিনম্র সংগ্রাম করেছিল। পাকিস্তানি মেজর অঝোর ধারায় ক্রন্দনরত আমার মাকে বিনীতভাবে সান্ত্বনা দিলেন। সৈন্যরা অস্ত্র নামিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল। আমার বাবা, ভাই, বোনেরা আর আমি মাকে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম মনে নেই।

করোনাভাইরাসে পজিটিভ হওয়ার দুদিনের মাথায় মায়ের অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। আইসিইউর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এলোমেলো। প্রবীণ ডাক্তাররা কেউ আসেন না। বুক এক্স-রে করে দেখা গেল মায়ের ফুসফুসের অনেকাংশই ভাইরাসে আক্রান্ত। পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, মাকে নিজ গৃহেই, তার নিজের বিছানায় নিয়ে যাওয়া হবে। তার পরিচিত পরিবেশ, তার শান্তিই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আইসিইউতে আসার ২৪ ঘণ্টা পরেই রাত ১২টায় তাকে নিজ গৃহে স্থানান্তর করা হয়। তার নিজ বিছানায় দুই ঘণ্টা পরে তিনি চলে যান এই পৃথিবী ছেড়ে। আমার বোন চিকিৎসক তাহমিনা পাশে বসে পবিত্র কোরআন পড়ছিল।

ভিডিও ফোনে শেষবারের মতো মায়ের নিস্তব্ধ মুখটা দেখলাম। ভাবছিলাম, মায়েরা কেন ৫০০ বছর বাঁচে না। কান্না ছাড়া মায়েদের বিদায় জানানোর আর কি কোনো ভাষা কারও জানা আছে? হয়তো নেই, কিন্তু কাহলিল জিব্রানের এই কথাটায় কিছুটা ইঙ্গিত আছে সেই ভাষার: মা হচ্ছে মানবতার ঠোঁটে সবচেয়ে সুন্দর শব্দ।

মনে পড়ে গেল ১৯৭১ সালের সেই দিনটির কথা, কেন সেদিন পাকিস্তানি মেজর আমার বাবা আর ভাইদের হত্যা করেনি, সেটা এখনো আমার কাছে একটা গোলকধাঁধা। সেটা কি মায়ের হাতে কোরআন শরিফ দেখে, নাকি মাতৃত্বের শাশ্বত আবেদনে উদ্বেলিত হয়ে, নাকি দুটোই, সেটা কখনো বোঝা হয়নি। এই না বোঝার মধ্যেই একধরনের মৌলিক শক্তি অনুভব করি। মাতৃত্বের এই রহস্যময় শক্তির কাছে কোভিড-১৯ কিছুই না। মা, বেহেশতের সবচেয়ে সবুজ বাগানে, সৃষ্টিকর্তার ছায়ায়, তুমি ভালো থাকবে আমি জানি। তোমার পদধূলি আমাদের যাত্রার চালিকা শক্তি হবেই।

আদনান জিল্লুর মোর্শেদ: স্থপতি, স্থাপত্য ইতিহাসবিদ, নগরবিদ ও অধ্যাপক। [email protected]