মাঠের একটি হাসপাতাল

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া প্রায় বারো বছর সুইডেনে প্রবাসজীবন কাটিয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখার জন্য কয়েক মাস আগে দেশে ফিরেছেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই সারা পৃথিবীতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড–১৯। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে সুইডেনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা (পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্ট) বিষয়ে। ঢামেকসুর ভিপি ছিলেন একসময়, সুতরাং নেতৃত্বদানের গুণটি তাঁর সহজাত। দেশের দুর্দিনে কী করা যায়, এই চিন্তা করতে শুরু করলেন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও যোগাযোগ করলেন।

নানা কিছু বিবেচনায় নিয়ে চট্টগ্রামে একটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিলেন বিদ্যুৎ। সুইডেনে থাকার সময় এ রকম বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতাল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলেন। ২৫ মার্চ ফেসবুকে প্রথম তাঁর পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করলেন। খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাজের কাজটি হলো। ৩০ মার্চ নাভানা গ্রুপের পক্ষ থেকে কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলেন তাঁর সঙ্গে। ফৌজদারহাট–সংলগ্ন সিটি গেট এলাকায় এই প্রতিষ্ঠানের সাত হাজার বর্গফুটের দোতলা একটি উন্মুক্ত শেড দিতে রাজি হলেন তাঁরা। কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করলেন না আর।

কিন্তু হাসপাতাল তৈরি আর চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের অর্থ আসবে কোত্থেকে? এবার ফেসবুকে লিখলেন, ‘এক লাখ লোক এক শ টাকা করে দিলে এক কোটি টাকার তহবিল গঠন হবে।’ এক লাখ জনের সাড়া মিলল না বটে, তবে অনেকেই এগিয়ে এলেন। ১ এপ্রিল ফেসবুকে তহবিল গঠনের কথা বলেছিলেন আর ২১ এপ্রিল ৩০ শয্যা নিয়ে শুরু হয়ে গেল ফিল্ড হাসপাতালের কাজ।

বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিলেন ৬-৭ জন চিকিৎসক বন্ধু। পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা। স্বেচ্ছাসেবক হতে ইচ্ছুক এ রকম তরুণদের আবেদন করতে বলা হয়েছিল। সাত শতাধিক আবেদন জমা পড়েছিল। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করা হয়েছে পঞ্চাশ জনকে। এই স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য বিশেষ শর্ত ছিল প্রত্যেককেই পিতা-মাতার স্বাক্ষর করা অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে, যেখানে উল্লেখ থাকবে মৃত্যুঝুঁকির কথাও।

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ডা. বিদ্যুৎ বললেন, ‘প্রথমে আমি নিজেই জমা দিয়েছি অঙ্গীকারনামা, কিন্তু এতগুলো তরুণ ও তাঁদের পিতা-মাতার অঙ্গীকারনামা হাতে পেয়ে আমি সত্যি বিস্মিত! আমার মনোবল সেদিনই বেড়ে গিয়েছিল শতগুণ।’ পেশাদার নার্সদের সঙ্গে এই স্বেচ্ছাসেবীরা দিনরাত কাজ করছে এখন। সব মিলিয়ে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা মাঠ-হাসপাতালটি করোনাকালে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের মতো।

এ যাবৎ সহস্রাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন ফিল্ড হাসপাতালে। ৭৪ জন করোনা পজিটিভসহ মোট ১২৫ জন রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে এখানে। অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। শুধু জরুরি অবস্থায় আসা তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এখন সরকারের পক্ষ থেকে তিনজন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী, সাংসদেরা হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে এক থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দিয়ে গেছেন ব্যক্তিগত তরফ থেকে।

করোনা চিকিৎসার জন্য সাধারণ হাসপাতালের চেয়ে এ ধরনের মাঠ হাসপাতাল অধিক কার্যকর ও নিরাপদ এ কথা স্বীকার করে ডা. বিদ্যুতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কেউ এর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য কী? একটু বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, ‘সেই ধারণা তো রাজনীতিক বড় ভাই আগেই দিয়েছিলেন। তবে একটা সাধারণ প্রশ্ন কেন সমালোচকদের মনে কি আসে না, একটা মানুষ দুর্নীতি করতে চাইলে, অর্থ আত্মসাৎ করতে চাইলে, জীবন-মৃত্যুর মাঠে দাঁড়িয়ে করবে কেন? রাতদিন হাসপাতাল নিয়ে পড়ে আছি, যদি কিছু হয়ে যায়...যদি রোগের সংক্রমণে মারা যাই, টাকা-পয়সা দিয়ে কী হবে!’

তবে এসব সমালোচনায় কান না দিয়ে নিজের কাজ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ডা. বিদ্যুৎ। তাঁর মতে, শেষ পর্যন্ত দুর্দিনে রোগীরা সেবা পেয়েছিল কি না, সেই কথাটাই মনে রাখবে মানুষ, সমালোচনাটা মনে রাখবে না। চট্টগ্রামের সিটি গেট এলাকার ফিল্ড হাসপাতালটিই দেশের প্রথম এ ধরনের হাসপাতাল কি না, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘সেটা জানি না, তবে দেশে আরও অনেক ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনেও তাই মনে করেন। তাঁর মতে, হঠাৎ এসে পড়া এই রোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি দেশের প্রচলিত হাসপাতালগুলোতে ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খেলার মাঠ, স্কুল বা কোনো ছাউনির নিচে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশেও এ রকম অনেক হাসপাতাল গড়ে তোলা উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। এ ক্ষেত্রে তরুণ চিকিৎসক বিদ্যুৎ ও তাঁর সহকর্মীদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান তিনি। চট্টগ্রামের এই হাসপাতাল অনুকরণীয় হয়ে উঠুক সারা দেশে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]