ইমরান খানের দিন ফুরিয়ে আসছে

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ছবি: রয়টার্স

পরিবর্তন দুনিয়াকে সচল রাখে। স্থবিরতা সমাজকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজের (পিএমএলএন) নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) নেতৃত্বে যখন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল, তখন গোটা দেশ স্থবির হয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের দ্বন্দ্বের ফলে অর্থনীতি থেকে সংবিধান—সবখানেই সংকট শুরু হয়েছিল।

আদালত তড়িঘড়ি করে নামকাওয়াস্তে শুনানির পর যেভাবে নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন এবং যেভাবে তাঁকে অপমান করে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। ২০১৮ সালে যেভাবে ভোট কারসাজির মাধ্যমে ইমরান খানকে নির্বাচিত করে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়েছিল, তা–ও ইতিহাস হয়ে থাকবে।

এখন সেই ইমরানের পিটিআই সরকার বেকায়দায় পড়েছে। এই সরকার অর্থনৈতিক অবস্থাকে আগের চেয়ে শুধু খারাপই করেনি, বরং নওয়াজ শরিফের ব্যর্থতার কারণে যেসব খাতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণ করতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। অদৃশ্য মহলের চাপে পড়ে নওয়াজকে দোষী বলে রায় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে বিচারপতি আরশাদ মালিক স্বীকার করার পর পাকিস্তানের বিচার বিভাগ ও ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোর (ন্যাব) মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস করে, পর্দার আড়ালে থাকা শক্তিই নওয়াজকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছে, তারাই ইমরান খানকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। পিটিআই যে কৃত্রিম বেলুনের ওপর ভর করে এসেছে, সে বেলুন আজ না হয় কাল ফাটতই। এখন মনে হচ্ছে সেই দিন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, যেদিন জাতীয় পরিষদে পিটিআইয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা কঠিন হবে।

পিটিআইয়ের জোটসঙ্গী বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি-মেঙ্গাল (বিএনপি মেঙ্গাল) জাতীয় পরিষদে পিটিআইয়ের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের আরেক জোটসঙ্গী পাকিস্তান মুসলিম লিগ কায়েদে আজম (পিএমএল-কিউ) সরকারের শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। সাবেক সামরিক জান্তা সরকারপ্রধান পারভেজ মোশাররফের দল পিএমএলকিউ যখন সরকারের অংশীদার হয়েও সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন বোঝাই যায় ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। যে অদৃশ্য শক্তি ইমরানের নেতৃত্বাধীন হাইব্রিড সরকারের জন্ম দিয়েছে, সেই শক্তিই এখন পিটিআই ও ইমরান খানের কাজকর্মে আস্থা রাখতে পারছে না।

জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়া পিটিআই সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিচারপতি কাজী ফয়েজ ইসার বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টের কাছে নালিশ জানানো হয়েছে। এটি বিচার বিভাগকেও খেপিয়ে তুলেছে। কাজী ফয়েজ ইসার বিরুদ্ধে স্ত্রী ও সন্তানদের সম্পদের হিসাব গোপন করার অভিযোগ তুলেছে সরকার। তবে সেই অভিযোগ খুবই অস্পষ্ট।

কাজী ফয়েজের স্ত্রী ভিডিও লিংকের মাধ্যমে তাঁর স্থাবর–অস্থাবর সব সম্পদের হিসাব জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোক তাঁদের হেনস্তা করছে। তাঁর সব সম্পদের নথিপত্র তিনি সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে এই বিচারপতির বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ জনগণের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। এরপর বিন্দুমাত্র নৈতিকতা থাকা যেকোনো সরকারের উচিত এই মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা তা দেখছি না। অন্যদিকে, ভারত ও চীনের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে পিটিআই সরকার কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না। ইসলামাবাদের এই অস্পষ্ট অবস্থান বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করছে। গত শনিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজিয়ান ঝাও বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে টেলিফোন করে তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন। শাহবাজ শরিফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁকে সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ঝাও। এতে আন্দাজ করা চলে, চীনের পাল্লা এখন পিএমএলএনের দিকে ভারী হয়েছে।

সৌদি রাজপরিবারের আশীর্বাদও ইমরানের ওপর থেকে উঠে যাচ্ছে। অন্যদিকে, আগামী মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক নেতা জো বাইডেনের জেতার সম্ভাবনা বেশি। যদি তিনি নির্বাচিত হন, তাহলে পিটিআই সরকার আরও চাপে পড়বে। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পরিবারের সঙ্গে নওয়াজ পরিবারের পারিবারিক সখ্য দীর্ঘদিনের। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ধরা যায়, জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে শাহবাজের পক্ষে ওয়াশিংটনের সুদৃষ্টি কাড়া কঠিন হবে না। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র , এটাই বাস্তবতা। ফলে শিগগিরই পাকিস্তানের ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে পারে বলে মনে করা যেতে পারে। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফল মুখ্যত পাঞ্জাবের ভোটারদের ওপর নির্ভর করে। সেই পাঞ্জাব এখনো শরিফ পরিবারের অনুগত আছে।

ইমরান খানকে সামরিক প্রতিষ্ঠান এতটাই প্রকাশ্যভাবে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে যে তারা জনসমালোচনার একটা চাপ এখন উপলব্ধি করতে পারছে। এতে সামরিক বাহিনীর মধ্যেও সমালোচনা হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বের হতে সামরিক বাহিনীও তার কৌশল বদল করতে পারে। পিটিআইয়ের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলছেন, তাঁদের নেতার অযোগ্যতার কারণে দলটির ক্ষমতা ধরে রাখা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। তাঁরা মনে করছেন, বিরুদ্ধ বাতাস বওয়া শুরু হয়ে গেছে। শিগগিরই একটা ঝড় উঠবে এবং দেশটির গোটা রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

ইমাদ জাফর: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক