জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ-দুর্নীতি

যখন গোটা দেশ করোনাভাইরাসের মহাদুর্যোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি এটিকে আখের গোছানোর মওকা হিসেবে নিয়েছেন। করোনাকালে এর চেয়ে নিন্দনীয় কাজ আর কী হতে পারে! এই কথিত জনপ্রতিনিধিরা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির চাল তছরুপ করেছেন, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজির চাল নিজেদের ঘরে গুদামজাত করে রেখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহায়তা কর্মসূচির তালিকায় নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম ঢুকিয়েছেন।

সব ক্ষেত্রে সরকার ত্রাণচোরদের ধরতে পেরেছে, তা–ও নয়। তারপরও ১০০ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল এই ভেবে যে অন্যরা সমঝে চলবেন। কিন্তু গতকাল সোমবার প্রথম আলোয় ‘জনপ্রতিনিধির ত্রাণ-দুর্নীতি: বরখাস্ত হওয়া অনেকে এখনো তৎপর’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটি নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যে ১০০ জন জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে, তাঁরা নানা তৎপরতায় স্বপদে ফিরে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রতিনিধিদের মধ্যে আছেন ৩০ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ৬৪ জন ইউপি সদস্য, চারজন পৌর কাউন্সিলর, একজন উপজেলা কাউন্সিলর ও একজন জেলা পরিষদ সদস্য। তবে এর বাইরেও অনেক জনপ্রতিনিধির নানা দুষ্কর্মের খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে, তঁাদের মধ্যে ৯০ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর দলের উচিত ছিল তঁাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া। দলীয় গঠনতন্ত্রে আছে, কোনো পদাধিকারী অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তিনি দলে থাকতে পারবেন না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দল কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা নেই।

আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারক বলেছেন, ‘অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে দল ও সহযোগী সংগঠন থেকে নিশ্চিত বহিষ্কার করা হবে।’ তাঁরা কবে বহিষ্কার করবেন? প্রশাসনিক তদন্তে তো এই জনপ্রতিনিধিরা অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কথায় বলে, ছাগল নাচে খুঁটির জোরে। জনপ্রতিনিধি নামধারী এই দুর্নীতিবাজদের খুঁটির জোরটি হলো দল। দলের মনোনয়নের পর তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন। এখন রাজনৈতিক দল যদি দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্তদের দেখেও না দেখার ভান করে, তাহলে দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

দল কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিরা নানাভাবে স্বপদে ফিরে আসার এবং ত্রাণকাজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছেন। কয়েকজন উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন বলে খবর এসেছে। আবার অনেকে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গায়ের জোরে ত্রাণকাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিচ্ছেন বলে তথ্য–প্রমাণ আছে। এই দুর্নীতিবাজেরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে একবার পদে ফিরতে পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রভাবিত করবেন।

আমরা মনে করি, যেসব জনপ্রতিনিধি ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁদের কেউ যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ত্রাণকাজে জড়িত হতে না পারেন, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে উচ্চ আদালতে যেতে হবে। জনপ্রতিনিধি নামধারী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চাই কঠোর পদক্ষেপ।