নারী নেতৃত্বের দেশে রাজনীতিতে পিছিয়ে নারী

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ২০২০ সালের মধ্যে সর্বস্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণের যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা তুলে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনীতে এই শর্ত পূরণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু ২০২০ সালের মাঝামাঝি এসে দেখা যাচ্ছে, কোনো রাজনৈতিক দল শর্ত পূরণের ধারেকাছে আসতে পারেনি। আর নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন ২০২০’ শিরোনামে যে খসড়া তৈরি করেছে, তাতে কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে একটি অস্পষ্ট ধারা যুক্ত করেছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল পর্যায়ের কমিটি ন্যূনপক্ষে ৩৩ ভাগ পদ মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য থাকিবে।’

 যথেষ্ট সময় হাতে পেয়েও রাজনৈতিক দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার শর্ত পূরণ করেনি। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল তাদের কৈফিয়ত চাওয়া।

 ১ জুনের বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, রাজনৈতিক দলের কমিটিতে এক–তৃতীয়াংশ নারী রাখার বিধান বাদ দেওয়া হবে সংবিধানের চেতনা ও নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী। এতে যেসব ধর্মবাদী দল শুরু থেকে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করে আসছিল, তারা আশকারা পাবে। কিন্তু তাঁর আপত্তি গ্রাহ্য হয়নি।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই আইন প্রণয়ন খুব সহজসাধ্য ছিল না। বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে তখন ইসিকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। অনেক ইসলামি দল কমিশনারদের মুরতাদ ঘোষণা করার হুমকি দিয়েছিল। সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, ভালো পরিবর্তনগুলো যাতে নষ্ট না হয়। এই শর্ত তুলে দিলে ইসি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে সময়সীমা আরও পাঁচ বছর বাড়ানো যেতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো সংস্কার উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত সফল হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে অনেক বলে, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে সেসব মনে রাখে না। সংবিধানে নারী–পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁদের অংশীদারত্ব অর্থাৎ ৫০: ৫০ থাকার কথা। বাংলাদেশের আর্থরাজনৈতিক বাস্তবতার কথা চিন্তা করে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের কমিটিতে এক–তৃতীয়াংশ বা ৩৩ শতাংশ নারী রাখার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। ১২ বছর কম সময় নয়।

সংগঠনের সব পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ে ৩৩ ভাগ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করবে, এই শর্তেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছিল। কয়েকটি ধর্মীয় দলও এ শর্ত মেনে নিবন্ধিত হয়েছিল। পরে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয় যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে।

আরপিওর বাধ্যবাধকতার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা হলেও বেড়েছে। ২০০৮ সালের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী সদস্য ছিল ১০ শতাংশ, বিগত কাউন্সিলে সেটি ২৪–এ উন্নীত হয়েছে। বিএনপির কেন্ত্রীয় কমিটিতে ১৫ শতাংশ নারী সদস্য আছেন। অবশ্য জাতীয় পার্টিতে সে রকম কোনো নিয়মকানুনের বালাই নেই। এরশাদ দল চালাতেন ‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট’ পদ্ধতিতে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে চলছে ভাবি–দেবরের রশি টানাটানি। যেসব বাম দল বুর্জোয়া দলের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তোলে, তাদেরও গণতান্ত্রিকভাবে কমিটি হয় না, নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে না।

সব রাজনৈতিক দলের জেলা–উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো প্রায় পুরোটাই পুরুষনিয়ন্ত্রিত। তৃণমূলে কোনো দলেরই সম্মেলন নিয়মিত হয় না। সম্মেলন হলেও কমিটি হয় না। জেলা পর্যায়ের কোনো কোনো পদাধিকারী দু–তিন দশক ধরে একই পদ আকঁড়ে আছেন। ‘ক’ দলের মাস্তান ঠেকাতে ‘খ’ দলকেও মাস্তান পুষতে হয়। এ অবস্থায় নারী নেতৃত্ব আসবে কীভাবে?

স্থানীয় সরকারে এক–তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখার কথাটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কাঠামোটাই এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে তাঁরা নির্বাচিত হলেও ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত হন। সাধারণ আসনে নির্বাচিতদের নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা আছে। নারী সদস্যদের কার্যত তা নেই। বলা হয়েছে, একজন নারী সদস্য তিনটি ওয়ার্ডের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু ওই তিন ওয়ার্ডে একজন করে পুরুষ সদস্যও আছেন। তাহলে নারী সদস্যদের নির্বাচনী এলাকা কোনটি? ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নারী প্রতিনিধিরা এই সমস্যার মুখোমুখি। তাঁদের পদ আছে, কাজ নেই।

 ১৯৯১ সাল থেকে মাঝখানের দুই বছর (২০০৭–২০০৮) বাদ দিলে ২৮ বছর ধরে দেশ নারী নেতৃত্বের অধীন। প্রধানমন্ত্রী নারী। সংসদে বিরোধী দলের নেতা নারী। গত দুটি সংসদে স্পিকারও নারী। কিন্তু নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে যা বোঝায়, তা অনুপস্থিত। অথচ প্রতিবেশী নেপালে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। তারা এমন আইন করেছে যে স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে প্রধান ও উপপ্রধানের পদটি সমভাবে ভাগ করা আছে। প্রধান পদে একজন পুরুষ এলে উপপ্রধান হবেন নারী, আবার প্রধান নারী হলে উপপ্রধান হবেন পুরুষ। বর্তমানে নেপালের প্রেসিডেন্ট একজন নারী।

 আমাদের রাজনীতিকেরা ওয়াদা করেন ওয়াদা ভাঙার জন্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই সরাসরি ভোটে জাতীয় সংসদে নারী সদস্যদের নির্বাচিত করার কথা বলেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা সেই পুরোনো ধারাতেই চলেছে। ১৯৮৬ সালের সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ছিল ৩০টি। ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে মাত্র ৫০টি, কিন্তু ওই সংরক্ষিত তকমা নিয়েই। তাহলে ৩৪ বছরে আমরা কতটা এগোলাম? নারী নেতৃত্বের দেশে নারীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। তারা পিছিয়ে আছে সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে, ব্যবসা–বাণিজ্যে। শিক্ষাঙ্গনে নারী প্রায় সমান সমান হলেও কর্মক্ষেত্রে তঁাদের অংশগ্রহণ অনেক কম। একমাত্র তৈরি পোশাকশিল্পেই নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে বেশি।

এই বাস্তবতায় নারীর ক্ষমতায়নের গালভরা বুলি আওড়ানো বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। সরকার বা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে নারী থাকলেই প্রমাণিত হয় না নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি, ক্ষমতায়ন হয়েছে উত্তরাধিকারের। যেদিন নারী ঘরে–বাইরে লাঞ্ছনা ও নিগ্রহের শিকার হবেন না, সংরক্ষিত আসনের তকমা নিয়ে তাঁকে সংসদ ঢুকতে হবে না এবং বাসে–ট্রেনে–লঞ্চের অর্ধেক আসন নারী যাত্রী দ্বারাই পূর্ণ হবে, সত্যিকার অর্থে সেদিনই নারীর ক্ষমতায়ন হবে।

মানুষ সামনে এগোয়। ভূতের পা পেছনে যায়। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন পেছনেই হাঁটছে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]