করোনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর দায় কার?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ উর্বর ভূমি। এই উর্বরতা শক্তি গুজব ছড়ানো ও তাতে কান দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর করোনাকালেও তার শক্তি দুর্বল হয়নি। তথ্য গোপন করার প্রবণতা এবং তথ্যের অসংগতি গুজবের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ বা রাজ্যের একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কোভিড-১৯ ইস্যুতে ব্রিফিং করে থাকেন। আমরা অনেকেই দেখেছি, নিউইয়র্ক সরকার কীভাবে অকপটে তাদের সীমাবদ্ধতা, পিপিইর অভাব, সংগ্রাম, হতাশা, সক্ষমতা ও অক্ষমতা স্বীকার করেছে। প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের একটি দল অন্তর্ভুক্ত থাকত। নিউইয়র্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেউই কিন্তু গভর্নরকে দোষারোপ করেনি; বরং অত্যন্ত সততার সঙ্গে সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন, মানুষকে সব তথ্য দিয়ে গেছেন বলেই তিনি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছেন, আর পেয়েছেন জাতীয় বীরের মতো সম্মান।

একই রকম ব্যাপার কানাডায়ও লক্ষ করা গেছে। হয়তো অনেকে বলবেন, আমরা তাদের মতো ধনী দেশ নই এবং তাই তাদের মতো কিছু আশা ঠিক হবে না। ভালো কথা। তবে কেবল কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের ধনী দেশ হওয়া কি খুব বেশি আবশ্যক? আপনি যদি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না চান এবং উত্তর দিতে না চান, লোকজন তো ভাববেই নিশ্চয় কিছু লুকানোর আছে। তথ্যপ্রাপ্তি মানুষের অধিকার; এটা কোনো বিশেষ সুবিধা বা দয়া নয় এবং এই ধরনের মনোভাব কোনো উপকারেও আসে না। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা মহামারি নিয়ন্ত্রণের সহায়ক, আমাদের কি সেই আস্থা আছে?

এখন কোভিড-১৯–সম্পর্কিত কিছু পরিসংখ্যান সম্পর্কে কথা বলা যাক। জল্পনা আছে যে বাংলাদেশে নাকি ইতিমধ্যেই লাখ লাখ মানুষ সংক্রামিত হয়েছে, সাত লাখেরও বেশি লোক ঢাকাতেই সংক্রামিত হয়েছে ইত্যাদি। প্রয়োজনের চেয়ে কম পরীক্ষা করা এই জল্পনার খোরাক জুগিয়েছে। এর সমস্যার কারণও সবার জানা—শুরু থেকেই কোনো একটি প্রতিষ্ঠান একাই সব করতে চেয়েছিল। যা–ই হোক, প্রথম ৪৫ দিনের মধ্যে আমাদের পরীক্ষাপ্রতি পজিটিভ কেস ছিল প্রায় ৭ শতাংশ, তবে তার পরে এটি প্রায় ১৫ শতাংশ এবং শেষ কয়েক দিনে এই হার ২২ শতাংশ বা তারও বেশি হয়েছে। এই একই সময়ে (গত কয়েক সপ্তাহে) ভারতে এই সংখ্যা ৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানে প্রায় ১১ শতাংশ। যদি পরীক্ষা করার সক্ষমতা সংক্রমের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তবে এটাই কি স্বাভাবিক না যে সরকারের দেওয়া তথ্যে মানুষের আস্থা কম থাকবে?

আমাদের মৃত্যুর হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় কম, সুতরাং আমাদের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষমতা অসাধারণ। যদি এটি সত্যই হবে, তবে সমাজের ধনী ও ক্ষমতাবানদের শুধু নিয়মিত চেকআপের জন্য বিদেশে যেতে দেখি কেন? আমাদের মৃত্যুর হার কম, তবে এটি আমাদের জনসংখ্যার কাঠামোর কারণে। আমাদের জনসংখ্যার গড় বয়স ২৭ দশমিক ৫ এবং ইতালিতে তা ৪৮! যে দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেশি, সে দেশে মৃত্যুহারও বেশি। ৬০ বা কম বয়সীদের মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুহার বরং অনেক দেশের তুলনায় বেশি। সুতরাং বেশির ভাগ কৃতিত্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নয়, বরং দেশের জনসংখ্যার কাঠামোর।

অনেকে দাবি করেছিলেন, শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা ও আগাম প্রস্তুতির কারণে বাংলাদেশে কোভিড-১৯–এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন কি কেউ বিশ্বাস করে যে আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে? সাফল্য যদি প্রশাসন ও পরিচালনার কৃতিত্ব হয়, তবে ব্যর্থতা দায় জনগণের হবে কেন? এটি এমন একটি দেশ, যেখানে আইন ভঙ্গ করার ক্ষমতা একটি গর্বের বিষয় এবং তা সমাজে তার অবস্থানের জানান দেয়। কেবল ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই আইন ভাঙতে পারেন, দুর্বল সাধারণ মানুষ নয়। এই সমাজে সুপারিশের খুব একটা মূল্য নেই। যদি আমরা সফলভাবে মানুষের মুখ বন্ধ করতে পারি, কেন আমরা সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ নিশ্চিত করতে পারি না এবং একটি মাস্ক পরতে বাধ্য করতে পারি না?

আমরা প্রায়ই দেখেছি, পরামর্শদাতা এবং বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছিলেন এক, আর প্রশাসন করেছে আরেক। উপদেষ্টারা কেবল পরামর্শ দিতে পারেন, তাঁদের কার্যকর করার ক্ষমতা নেই। বিজ্ঞানকে বিশ্বাস না করা এবং বিজ্ঞানীদের পরামর্শ না মানা বোকামির সর্বোচ্চ রূপ আর মহামারির বেলায় এটা আরও বেশি সত্য। ব্রাজিল সেই মূল্য দিচ্ছে। ক্ষমতায় থাকলে অনেকে মনে করে যে তারা সবকিছু পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট স্মার্ট। কেন তারা অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী বা এসব লোকের কথা শুনবে? এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞ বলতে কাদের বোঝায়? বাংলাদেশে সংস্কৃতি হলো, বিশেষজ্ঞ হতে হলে আপনাকে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে হবে। বিশ্বের অনেক শীর্ষ সংস্থার সিইও দেখুন, তাঁরা বয়সে অনেক তরুণ। নবীনের উদ্যম আর প্রবীণের দক্ষতা—দুটোকেই কাজে লাগানো উচিত। সংক্রমণ বা মহামারি নিয়ন্ত্রণ কেবল জীববিজ্ঞান বা রোগতত্ত্ব নয়; বরং এটি অত্যন্ত জটিল এবং তাই আইটি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, এপিডেমিওলজিস্ট, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি (তথাকথিত নয়), মনোবিজ্ঞানী, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীসহ সব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন। তা আমরা কী করছি?

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে বেসরকারি খাতকে (বেসরকারি হাসপাতাল) কোভিড মোকাবিলায় সেভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কেন হলো? স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জন্য ঘোষিত সরকারি প্যাকেজটি বেসরকারি খাতেও কেন অন্তর্ভুক্ত করতে পারলাম না? সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতাল উভয়ের জন্য লাভজনক হয়—এমন একটা চুক্তিতে পৌঁছতে পারতাম না? মানুষ মারা যাচ্ছে এবং রোগীরাও লক্ষণ লুকিয়ে রাখছেন। সুতরাং ডাক্তাররা আতঙ্কিত হবেন—এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা কি তাদের মনোবল বাড়াতে উল্লেখযোগ্য কিছু করেছি? যাঁরা নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের সম্মান জানিয়ে সরকারের উচ্চ মহল থেকে ফোন বা চিঠি পাঠাতে পারতাম না। শোকজ পাঠাতে যে উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, মনোবল বাড়াতে সে রকম তৎপরতা এখানে দেখা যায় না কেন?

সরকারের একটি ‘ইনোভেশন সেল’ রয়েছে। তারা সবার কাছে সৃজনশীল ধারণা চাইতে পারে। এতে এমন ধারণা বের হয়ে আস্তে পারে, যা আশ্চর্যজনক ফলাফল দিতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বন্ধ রয়েছে এবং অনেক শিক্ষার্থী সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। আমরা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে এদের সহজেই সম্পৃক্ত করতে পারি। এদের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি, তরুণ প্রজন্ম জাতির জন্য কিছু করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবে এবং তারা তা করতে চায়ও।

তা ছাড়া কিছু কিছু জায়গায় একটি ‘পপুলেশন স্ক্রিনিং’ করতে পারে। এতে একদিকে যেমন সরকার প্রকৃত সংক্রমণ সম্বন্ধে কিছু ধারণা পাবে, একই সঙ্গে জল্পনাকেও ঠেকাতে পারবে।

সমস্যাগুলো আড়াল করার পরিবর্তে দয়া করে উন্মুক্ত মনে প্রশ্ন শুনুন, প্রশ্নকে ভালোবাসতে শিখুন। সমস্যা আড়াল করলে সমস্যা যায় না, বরং বাড়ে। জবাবদিহি এবং সংক্রমণের বৃদ্ধির বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে।

ড. শাফিউন নাহিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক