চীনা পণ্য বর্জনের ডাক কতটা বাস্তবসম্মত

গালওয়ান উপত্যকায় সম্প্রতি ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর ভারতের কিছু কট্টর চীনবিরোধী গ্রুপ ও ব্যক্তি চীনা পণ্য বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অঙ্গ সংগঠন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ (এসজেএম) এর নেতৃত্বে আছে।

আউটলুক ইন্ডিয়া ম্যাগাজিন–এর প্রতিবেদন বলছে, চীন ও চীনের সব ধরনের পণ্য বয়কটের সর্বাত্মক প্রচার করছে এসজেএম। চীনবিরোধী গ্রুপগুলো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে ভারতের একটি দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিতে চাইছে। এটি একেবারেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। খুবই পরিতাপের বিষয়, কিছু ভারতীয় বিশিষ্টজন ও সেলিব্রিটিও এ ধরনের প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন। অবশ্য তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘চীনা পণ্য বয়কট করো’ স্লোগান দিচ্ছেন তাঁরা। দেশটির সাবেক ক্রিকেটার হরভজন সিং টুইট করেছেন, ‘সব চীনা পণ্য নিষিদ্ধ করো’। অবসরপ্রাপ্ত মেজর রণজিৎ সিং বলেছেন, ‘চীনা পণ্য ফেলে দাও, চীনের অর্থনীতির কোমর ভেঙে দাও।’

 কোনো কোনো জায়গায় চীনবিরোধী মিছিলও হয়েছে। বিশালসংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের তুলনায় তাদের সংখ্যাও নগণ্য। লক্ষণীয় হলো চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কোনো ধরনের একটু ঝামেলা হলেই এই গ্রুপগুলো সক্রিয় হয় এবং দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

চীনা পণ্য আমদানির বিরুদ্ধে ভারতে অনেক আগেই প্রচার ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিবছরই চীন ও ভারতের বাণিজ্য বেড়েছে। ভারত আগের চেয়ে অনেক বেশি চীনা পণ্য আমদানি করছে। চীনের সঙ্গে ভারতের হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যঘাটতি আছে। চীন থেকে যত পণ্য ভারতে যায়, তার তুলনায় খুবই কম পণ্য ভারত থেকে চীনে যায়।

বহু পণ্য আছে, যা ভারত চীনের মতো স্বল্প খরচে উৎপাদন করতে সক্ষম নয়। বহু চীনবিদ্বেষী ভারতীয় আছেন, যাঁরা চীনের মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করেন। ওই একই সুবিধাসম্পন্ন ফোন সেট পশ্চিমা দেশ থেকে একই দামে পাওয়া সম্ভব নয়। এত কম দামে এত মানসম্পন্ন পণ্য চীনের বাইরে অন্য কোনো দেশ সরবরাহ করতে পারছে না। এখন ভারতের অনেক রাজনৈতিক দলও নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে চীনের পণ্য বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু এই পণ্যের বিকল্প বাজারের কথা কেউ বলছেন না।

ভারতের যেসব বুদ্ধিজীবী নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে থাকেন, তাঁরা বারবারই বলে আসছেন, এশিয়ার তৃতীয় বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে ভারতের পক্ষে এই মহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংঘাতে জড়ানো হবে একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত ও আত্মঘাতী কাজ। সীমান্ত ইস্যুর সঙ্গে অন্ধের মতো বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মতো বিষয় গুলিয়ে ফেলাও অযৌক্তিক। যাঁরা গঠনমূলক চিন্তা করেন, তাঁরা জানেন এই ইস্যু নিয়ে চীনা পণ্য বর্জন বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করলে দিন শেষে শুধু ভারতের ক্ষতি হবে না, গোটা অঞ্চলের সব দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিদ্যমান অবস্থা পর্যালোচনা করে ভারতকে অনুধাবন করতে হবে, চীনের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা দুর্বল নয়। দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকলে উভয়ের জন্যই তা মঙ্গলজনক হবে। এ কারণে ভারতীয়দের মধ্যে অতিমাত্রায় চীনবিদ্বেষ উসকে দেওয়া গোষ্ঠীগুলোকে ভারত সরকারের নিজের স্বার্থেই দমন করা উচিত এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে ধস নেমেছে, তা থেকে চীন বা ভারত কেউ রেহাই পাচ্ছে না। দুটি দেশকেই আর্থিক খাত নিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সংঘাত বাধলে তা চীনকে যতটা না ক্ষতির মুখে ফেলবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ভারতের। এই মুহূর্তে ভারত বিশ্বের চার নম্বর কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশ। তারপরও দেশটি তাদের লকডাউন অব্যাহত রাখতে পারেনি। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, দেশটি অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড চাপে আছে। জনগণের ব্যবসা-বাণিজ্য চাপের মুখে পড়েছে। গত মে মাসে
ভারতের রপ্তানি ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ে গেছে। অন্যদিকে এ বছর আমদানি বেড়েছে ৫১ দশমিক ১ শতাংশ। এ অবস্থায় চীনা পণ্য বর্জনের ডাক আবেগসর্বস্ব ও অবাস্তবিক।

গ্লোবাল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
লিউ জিয়াওজু: চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধীন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজির একজন রিসার্চ ফেলো