চীনের দখলদারি রুখতে ভারতকে যা করতে হবে

সম্প্রতি লাদাখে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: রয়টার্স
সম্প্রতি লাদাখে ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। ছবি: রয়টার্স

চীনের প্রখ্যাত সমরবিদ সান ঝুর বিখ্যাত একটি কথা হলো, ‘যদি তুমি নিজের এবং শত্রুর সম্পর্কে না জানো তাহলে সব লড়াইয়েই তুমি হারবে। যদি তুমি নিজের সম্পর্কে জানো কিন্তু শত্রুর সক্ষমতার বিষয়ে না জানো, তাহলে তোমার প্রতিটি জয়ের পরপরই হারের আশঙ্কা থাকবে। আর যদি তুমি নিজের ও শত্রুর উভয়ের বিষয়ে জানো, তাহলে শত লড়াইয়েও তোমার হারের আশঙ্কা নেই।’ 

রণকৌশলীরা সংঘাতরত পক্ষগুলোর কাজের ধরন, কথাবার্তা, আচার–আচরণ এবং তাদের নেতাদের স্বভাবচরিত্র দেখেন ও সেগুলোকে বিশ্লেষণ করেন। তবে শত্রুপক্ষকে ভেতর থেকে বুঝতে হলে সব সময় যে জিনিসটির ওপর গভীর মনোযোগ দিতে হয়, সেটি হলো তাদের সংস্কৃতি। চীন ও ভারতের মধ্যে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে, তাকে চীনের ঐতিহ্যবাহী ‘গো’ খেলা এবং ভারতের ঐতিহ্যবাহী দাবা খেলার সঙ্গে তুলনা করা যায়। দাবা খেলার উৎপত্তিস্থল ভারতবর্ষে। এতে খেলোয়াড় থাকেন দুজন। দাবার বোর্ডে ৬৪টি ঘর থাকে। এক পক্ষে ১৬টি সাদা ঘুঁটি, অন্য পক্ষে ১৬টি কালো ঘুঁটি। সাদা এবং কালো—এ দুই বাহিনীর লড়াই চলে। ১৬টি ঘুঁটি একটি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই ১৬টির মধ্যে সাধারণ সেনা থেকে রাজা পর্যন্ত থাকে। দুই পক্ষেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষের রাজাকে বন্দী বা ‘মাত’ করে দেওয়া। যে পক্ষের রাজা মাত হয়, সেই পক্ষের হার হয়। 

চীন দেশে প্রায় একই ধরনের একটি খেলা আছে, যার নাম ‘ইগো’। সবাই যাকে বলে ‘গো’। দাবার তুলনায় এর বোর্ড অনেক বড়। দাবায় ৬৪ ঘর থাকলেও এর ঘর ৩৬১টি। দাবায় যে রকম প্রতিপক্ষের সেনা শক্তিকে খেয়ে ফেলা হয়, এই খেলায় তা নেই। এই খেলায় উভয় পক্ষ বোর্ডের সর্বোচ্চ পরিমাণ ঘর অর্থাৎ জায়গা দখল করার চেষ্টা করে। বিরুদ্ধ শক্তিকে চাপতে চাপতে কোটগুলো দখল করতে করতে এগোতে হয়। এই খেলায় রাজাকে বন্দী করার কোনো ব্যাপার নেই। যে পক্ষ সবচেয়ে বেশি এলাকা দখল করে, সেই জয়ী নির্ধারিত হয়। 

লক্ষ করলে দেখা যাবে, চীন এখন ভারতের সঙ্গে এই ‘গো’ খেলাটা খেলছে। ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা দিক দিয়ে তারা ভারতকে কোণঠাসা করছে। ভারতকে কোণঠাসা করার জন্য ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে চীন এই খেলায় নামতে বাধ্য করছে। কাউকে অগাধ ঋণ দিয়ে, কাউকে অন্য সুবিধা দিয়ে চীন হাত করছে। 

ভারতের সেনাবাহিনীর সাহস ও দেশপ্রেম নিয়ে আমার নিজের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো চীনের অর্থনীতি ভারতের অর্থনীতির চেয়ে পাঁচ গুণ বড় এবং তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের চেয়ে চার গুণ বেশি। চীন এই মুহূর্তে ভারতের বিশেষত উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশগুলোকে কবজায় নিয়ে ভারতকে চাপে ফেলছে। এসব জায়গায় আমাদের সামরিক শক্তি নিয়োজিত ও ব্যয় বাড়াতে বাধ্য করছে। সর্বশেষ লাদাখের ঘটনায় চীন সরাসরি যুদ্ধের উসকানি দিয়েছে। এখন যদি ভারত সামরিকভাবে এর জবাব দিতে যায়, তাহলে লাদাখে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা চালাতে হবে। একই সঙ্গে চীনের সাইবার হামলা, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়েও সতর্ক হতে হবে। 

মান্দারিন ভাষায় ‘ইগো’ মানে চার দিক থেকে ঘেরাও করা। ভূরাজনৈতিকভাবে চীন যে ভারতকে ঘেরাও করার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, তা ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ (চীন থেকে হর্ন অব আফ্রিকা পর্যন্ত পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ হয়ে সোমালিয়া পর্যন্ত যে নৌপথ)-এর দিকে তাকালে বোঝা যায়। এই অঞ্চল এবং ভারতের উপকূলীয় এলাকায় তারা আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ ছাড়া ভারতের উত্তর অঞ্চলে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে যে প্রকল্প নিয়ে চীন এগোচ্ছে, সেটিও ভারতকে ঘিরে ফেলায় ভূমিকা রাখবে। নেপাল ও ভুটানকে নিজের মুঠোয় নিয়ে তাদের ভারতের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে বাধ্য করছে চীন। 

এ বিষয়গুলোকে মাথায় নিয়ে ভারতকেও এই রণকৌশল অনুসরণ করে পাল্টা আঘাত করতে হবে। 

প্রথমত, চার দিক থেকে কাউকে আটকানো হলে সেই বলয় ভাঙতে বলয়ের ভেতর থেকেই যে আঘাত হানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বাইরের দিক থেকেও আঘাত হানা যায়। এ ক্ষেত্রে ভারত ‘গো’ বোর্ডটিকে বড় করে নিতে পারে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম—এই দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক তিক্ত। এই দেশগুলোর সঙ্গে ভারত আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে তাদের দিয়ে চীনের ওপর চাপ ফেলতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে গো বোর্ডের ভেতরের ঘুঁটিগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বে নিতে হবে। তাদের সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সম্মান দিতে হবে। ভারতকে এমন একটি পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতে হবে, যা অভিন্ন থাকবে। অর্থাৎ ভারতের সরকারে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সেই সরকার সেই অভিন্ন নীতি মেনে সামনে এগোবে। 

তৃতীয়ত ও সর্বশেষ যেটি দরকার সেটি হলো, দেশের ভেতরের স্থিতিশীলতা। ভারতের অর্থনীতি এখন নানা কারণে পড়তির মুখে। এর মধ্যে রাজনৈতিক হানাহানি ও বিভেদ ছড়িয়ে পড়লে তা অর্থনীতির জন্য প্রচণ্ড ক্ষতির কারণ হবে। সেটি ভারতকে বেকায়দায় ফেলার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে চীন।

 হিন্দুস্তান টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

রঘু রমন ভারতের গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স গ্রিডের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা