যুদ্ধ ও নিপীড়ন কোথাও থামেনি

মহামারি–অতিমারি কি আমাদের বিবেককে আর্দ্রতাসিক্ত করবে না? ছবি: এএফপি
মহামারি–অতিমারি কি আমাদের বিবেককে আর্দ্রতাসিক্ত করবে না? ছবি: এএফপি

সারা বিশ্ব করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত হলেও থামেনি দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, জাতি ও গোষ্ঠীগত নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণে আক্রমণ–প্রতি আক্রমণ। বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সমান বা বেশি গুরুত্ব দিয়ে এখনো অস্ত্র ক্রয় করছে। মার্কিন এক টিভি প্রতিবেদনে দেখা গেল, করোনার সর্বগ্রাসী প্রভাবে সর্বত্র উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নিম্নমুখী হলেও তাদের অস্ত্র কারখানায় উৎপাদন দ্বিগুণ এবং নতুন নিয়োগ অব্যাহত আছে। বিভিন্ন বিবদমান রাষ্ট্র এ অস্ত্রশস্ত্র প্রতিযোগিতা করেই কিনছে। 

অন্য একটি সংবাদভাষ্যে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষুদ্র অস্ত্র ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপর্যায়ে এ অস্ত্র প্রতিযোগিতা দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, বিশ্বব্যাপী এ জীবনসংহারী অতিমারি কোনোভাবেই অনেক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে মানবতাবোধ জাগাতে পারেনি। একইভাবে পারেনি ব্যক্তি, সমাজ ও সম্প্রদায় পর্যায়েও মানবতাবোধ জাগাতে। সার্বিকভাবে মানবজাতির জন্য এটি করোনার চেয়েও অনেক বেশি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। করোনার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন একদিন আবিষ্কার হবে। অমানবিক রাজনীতি ও ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে মনুষ্যত্বের বলিদান, যুদ্ধবাজি, অস্ত্র ব্যবসা নিরুৎসাহিত করার তো কোনো টিকা-ভ্যাকসিন কখনো তৈরি হবে না। 

মধ্যপ্রাচ্য, সন্নিহিত আফ্রিকা অঞ্চল, পারস্য, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া এবং চীনসহ অনেক দেশে জাতিগত ও গোষ্ঠীগত নিপীড়ন, ক্ষমতার রাজনীতির যূপকাষ্ঠে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নির্মম বলিদান এবং অন্য রাষ্ট্রকে আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণ, আক্রমণে প্ররোচনা, ধর্মীয় জঙ্গিপনা, ইত্যাদি সমানে চলছে। কম করে হলেও চল্লিশ বছর ধরে আফগানিস্তান অশান্ত। ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের ইরান আক্রমণ দিয়ে যে প্রথম পারস্য যুদ্ধ শুরু, ১৯৮৮ সালে উভয় পক্ষের প্রায় ৬ লাখ লোকের প্রাণহানি ও অসংখ্য হতাহতের পর যুদ্ধবিরতি হয়। তারপর আবার সাদ্দামের কুয়েত অভিযান (১৯৯০), সাত মাস পর অপমানজনক সমাপ্তি। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ এবং সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি (২০০৬, ডিসেম্বর ৩০)। সেই ইরাক এখনো অশান্ত। 

২০১০–এ শুরু হলো আরব বসন্ত। তার ধাক্কায় কেঁপে উঠল তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন ও বাহরাইন। বেন আলী, মোবারক ও সালেহ ক্ষমতা হারান। আসাদ আর গাদ্দাফি গণ-অভ্যুত্থান দমনে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করতে থাকেন। সাদ্দামের পর পশ্চিমা প্ররোচনার দ্বিতীয় বলি হন গাদ্দাফি। তাঁকে নির্মমভাবে রাস্তায় পিটিয়ে মারা হয়। সেই লিবিয়ায় এখনো সত্যিকার অর্থে কোনো সরকার নেই। ২০১১ থেকে সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ শুরু, তা পরিণতিবিহীনভাবে এখন ১০ বছরে পড়ল। ইতিমধ্যে সামরিক–বেসামরিক মিলিয়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ নিহত, হতাহত অসংখ্য এবং ৩৫ লাখ বাস্তুচ্যুত। সেই আসাদ এখনো ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছেন দেশের অর্ধেক অংশের সম্রাট হয়ে। 

সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে ভয়াবহ ও জঘন্যতম ঘটনা হচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিসর, মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, জর্ডান ও বাহরাইনের একটি জোট কর্তৃক ইয়েমেনে আগ্রাসন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখানে সহযোগী। ১ কোটি ৩০ লাখ গরিব ইয়েমেনির ওপর এতগুলো রাষ্ট্রশক্তির সম্মিলিত আক্রমণের পাঁচ বছর শেষ হলো। হাজার মানুষ যুদ্ধে হতাহত এবং বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপ। যুদ্ধের আক্রমণ ছাড়াও অভাবে, দুর্ভিক্ষে, রোগে মরছে হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে উভয় পক্ষে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সে যুদ্ধ থামার কোনো প্রচেষ্টা নেই। যুদ্ধরত সব পক্ষ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনছে। 

একসময় ইসরায়েল সবার সাধারণ শত্রু ছিল, এখন অঘোষিত মিত্র। এখন তারা নিজেরা একে অপরের শত্রু। শক্তিধর তুরস্ক যখন যাকে খুশি আক্রমণ করে। কুর্দি মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধে তাদের কোনো অনুশোচনা নেই। মিসর ইথিওপিয়া আর সুদানকে নীল নদের পানির হিস্যা দেয় না। ওই পুরো অঞ্চলে সৌদি আরব, ইসরায়েল, তুরস্ক ও ইরান এসব বিরোধ ও প্রাণঘাতী যুদ্ধের সামনের নিয়ন্তা শক্তি, পেছনের কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াই নাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য তথা পারস্য উপসাগরীয় এলাকা ও সন্নিহিত আফ্রিকা অঞ্চলে এ রকম আত্মঘাতী সংঘর্ষের কারণ খুব সহজ ও সাধারণ। বংশানুক্রমিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা এবং সে জন্য বিনা দ্বিধায় সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ এবং এ কাজে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক পশ্চিমা তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক-উদারপন্থী’ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ। 

কোনো দুর্যোগ–দুর্বিপাক, মহামারি–অতিমারি কি আমাদের বিবেককে আর্দ্রতাসিক্ত করবে না? আমরা ‘জীবন যেখানে যেমন’ এ রকম একধরনের আত্মস্বার্থ মগ্নতায় ডুবে থাকব। পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে স্বজাতি ও স্বধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল না। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও তুরস্ক হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য হত্যা, সুদীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ, গুম, খুন, নিপীড়ন থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। পৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় ধরে পবিত্র কাবাসহ সব মসজিদে জামাত বন্ধ থাকার ইতিহাস নেই। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে শিয়া-সুন্নি-সালাফি ইত্যাদি বিভাজনে রাজনীতি করা ও অকাতরে মানুষ মারার এ অপরাজনীতির কি কোনো ক্ষমা আছে? 

বর্তমান পারস্পরিক নির্ভরশীল বিশ্বে কেউ আমরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও রাষ্ট্র বিভাজনে একে অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। তাই চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষে আমরা বিচলিত। ইয়েমেনে বোমা পড়লে তা আমার গায়ে লাগে। সৌদি আরব অকাতরে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অস্ত্র কিনে সে অস্ত্র চালনায় আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে এবং সে অস্ত্র যখন সিরিয়ার বিদ্রোহী কিংবা ইরাকের সুন্নিকে শিয়া নিধনের জন্য বা ইয়েমেনে হুতিবিরোধী যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তখনই প্রতিবাদ করতে হয়। কারণ, হাজার নিরীহ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মচ্যুত হচ্ছে এবং করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে শুধু সে জন্য নয়, কারণ তাতে সারা মানবজাতি বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হচ্ছে। 

এই দুঃসময়ে আমরা শুধু আহ্বান জানাতে পারি, প্রত্যাশা করতে পারি। যুদ্ধবিবাদ থামুক, মানবিকতার বোধ জাগুক, মানুষ বাঁচুক। অস্ত্রবাজি ও অস্ত্রব্যয় কমুক, মানুষের জন্য স্বাস্থ্যব্যয় বাড়ুক। 

 ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষাবিদ ও শাসন বিশেষজ্ঞ