চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে তো?

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়লে শিল্প-কারখানায় একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান-অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটবে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়লে শিল্প-কারখানায় একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান-অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটবে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

প্রিয় পাঠকেরা, নিশ্চয়ই এই সন্দেহ নিয়ে ভাবছেন? আমার সন্দেহের ভিত্তি মূলত দুটি। এক, অতীতে আমরা চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ খুব একটা কাজে লাগাতে পারিনি প্রয়োজনীয় সক্ষমতার অভাবে। দুই, ভারতও ২০১১ সাল থেকে আমাদের প্রায় সমপর্যায়ের সুবিধা দিয়ে আসছে, তবে এতে দেশটিতে আমাদের রপ্তানি তেমন একটা বাড়েনি। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই বিজ্ঞজনেরা অশুল্ক বাধাকে দুষেছেন।

২০১০ সালে ৬০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৯৫ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও ২০২০ সালের মাঝামাঝি চীন সিদ্ধান্ত নিল, স্বল্পোন্নত দেশগুলো আমদানিযোগ্য ৯৭ শতাংশ পণ্য দেশটিতে শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারবে। শুরুর দিকে ৩৩টি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য এই সুবিধা কার্যকর হলেও পরে তা বাড়িয়ে ৪০টি দেশের জন্য করা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকসহ ১৭টি বৃহৎ রপ্তানি পণ্যকে শুল্কমুক্ত আমদানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চীনের কাছে প্রস্তাব দেয়। শোনা যাচ্ছে, চীন শুধু মেইজ ছাড়া বাকি ১৬টি পণ্যকে নতুন তালিকায় ঢুকিয়েছে।

করোনা অতিমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। প্রায় ছয় মাস ধরে বিশ্ব বাণিজ্যও প্রায় স্থবির। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের অংশ হওয়ায় বাংলাদেশও এর ভুক্তভোগী। বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ার কারণে পোশাক খাতের অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চামড়াসহ অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পেরও প্রায় একই দশা। দেশের অর্থনীতির এ স্থবিরপ্রায় পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার চীন একটি স্বস্তির বার্তা দিয়েছে বলেই প্রায় সবাই ধরে নিয়েছেন। তাদের বাজারে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের—অধিকন্তু আরও ৩ হাজার ৯৫টি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি–সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে দেশটিতে মোট শুল্কমুক্ত পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮ হাজার ২৫৬টি। ফলে চীনে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ৯৭ শতাংশই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় এসেছে বলে সংবাদে প্রকাশ। আগামী ১ জুলাই থেকে এ সুবিধা কার্যকর হবে বলে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। রপ্তানি খাতকে চাঙা করতে চীনের দেওয়া এ সুবিধার সদ্ব্যবহারে দেশের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ কাম্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে এ অঞ্চলে চীনা পণ্যের বড় ক্রেতা বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য রপ্তানির গতি খুব একটা বাড়ছিল না। এবার চীনের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পথ আরও উন্মুক্ত হলো। বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বেসরকারি সূত্রমতে শুল্ক–এড়ানো পণ্যের পরিমাণ ধরলে, এর পরিমাণ আরও বেশি)। বিপরীতে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮৩১ মিলিয়ন ডলার। মাঝখানে এক বছর এই অঙ্কটি ৯০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও চীনে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ক্লাবে বাংলাদেশ অদ্যাবধি ঢুকতে পারেনি, যদিও জাপান ও ভারতের এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য আর কানাডার কথা নাই-বা বললাম।

 তার মানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান বিপুল। এ ব্যবধান কমানোর এখনই সুযোগ। বিপুল জনসংখ্যার দেশ চীন। সেই বিবেচনায় বাজারও অনেক বড়। বিগত বছরগুলোয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে লক্ষণীয় মাত্রায় ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে দেশটির জনগণের। ঘোষিত শুল্কমুক্ত সুবিধা ব্যবহার করে দেশটিতে রপ্তানি বাড়ানো গেলে তা বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুফল বয়ে আনবে। বিশেষ করে চীনে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ, তৈরি পোশাক, কাঁচা চামড়া, প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কাঠের আসবাব, হিমায়িত খাদ্য, মাছ ও শাকসবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্ভাবনাময় এ বাজার কাজে লাগানো গেলে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর রপ্তানি যেমন বাড়বে, তেমনি বিরাজমান বাণিজ্যবৈষম্যও অনেকটা কমে আসবে।

অধুনা শিল্পনীতিতে চীন তার শিল্পসংক্রান্ত পরিপালন অনেক কঠোর করেছে। ফলে সেখানে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া দেশটি শিল্প খাতকে ধীরে ধীরে হালকা শিল্প থেকে ভারী শিল্পের দিকে রূপান্তরে মনোযোগ দিয়েছে। এখন দেশটি সস্তা পণ্যের চেয়ে ব্যয়বহুল পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী বেশি। এতে করে শ্রমব্যয় ও মূলধনি যন্ত্রপাতির ব্যয়ও বাড়ছে। এ জন্য দেশটি অন্য দেশে কারখানা স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে এবং যারা বেশি সুযোগ দিচ্ছে, সেখানে বিনিয়োগের সুবিধা গ্রহণ করছে। বিশেষ করে যেসব দেশে শ্রমব্যয় কম, সেসব দেশকে এ ক্ষেত্রে তারা প্রাধিকার দিচ্ছে। সীমান্তে রক্তারক্তি হলেও ভারতও তার বাইরে নয়।

 বাংলাদেশ এখনো সস্তা শ্রমের দেশ বলে বিবেচিত। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও তৎপর একটি দেশ। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার অভৌত ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অব্যাহতভাবে মনোযোগী। সেদিক থেকে বাংলাদেশ চীনা বিনিয়োগের একটি লাভজনক গন্তব্য হতে পারে। এখানে কারখানা স্থাপন বা বিনিয়োগ করলে তারা যেমন সস্তা শ্রমের সুবিধা পাবে, তেমনি শূন্য শুল্কের সুবিধার অধীনে আবার এখানকার উৎপাদিত পণ্য দেশটি আমদানিও করতে পারবে। এতে পরোক্ষভাবে দেশটিও লাভবান হবে। একইভাবে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়লে শিল্পকারখানায় একদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান-অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটবে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে আমাদের বাংলাদেশ।

চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগাতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। চীনে কী ধরনের পণ্যের চাহিদা রয়েছে বা বাংলাদেশ তাদের চাহিদা মেটাতে পারে, তা অনুসন্ধান এবং দেশটির আমদানি প্রটোকল মেনে পণ্য রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে পণ্য রপ্তানিতে আমাদের যে সমস্যা ছিল বৈচিত্র্যকরণ ও মূল্য সংযোজনের (ভ্যালু অ্যাডিশন) অভাব, তা চীনে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা এমন এক দেশে পণ্য রপ্তানি করতে চাইছি, যারা অধিকাংশ পণ্য নিজেরাই তৈরি করে এবং সেখানে একই পণ্য বিভিন্ন মানে ও দামেও পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে স্বল্পমূল্যে মানসম্পন্ন পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে।

এ ছাড়া চীনের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হিসেবেও বাংলাদেশ কাজ করতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। চীনের বিনিয়োগ এবং চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিনিয়োগ আকর্ষণেও আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এতে চীনে রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে বৈকি। চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতকে চাঙা করতে পারে। তবে এ সুযোগ কাজে লাগাতে আমাদের গবেষণা জোরদার, পণ্য বৈচিত্র্য আনয়ন, নতুন পণ্য তৈরি এবং চীনের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহে দৃষ্টি দিতে হবে। বলা হচ্ছে, ২০২৪ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে আমরা আর এ সুবিধা পাব না, সেটিও বিবেচনায় রেখে এগোতে হবে।

বিশ্ব রাজনীতির সাম্প্রতিক পরিবর্তনে নিজের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার জন্য চীনের অনেক বন্ধু দরকার। আমরা ইতিমধ্যে স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের জন্য চীনের ঋণ-ফাঁদের কথাও শুনে আসছি। তাই বাংলাদেশের জন্য সেই বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ চীন যদি তার বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশকে বাধাহীন করে দেয়, তবে তা অবশ্যই আনন্দ সংবাদ। তবে বাংলাদেশকেও নিজের উৎপাদন সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়িয়ে এই সুবিধাকে যথাযথ কাজে লাগাতে হবে।

 মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক