গভীর হচ্ছে মানুষের যোগাযোগ

অমিতাভ ঘোষ। ছবি: তাঁর টুইটার পেজ থেকে

প্রখ্যাত ভারতীয় ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের পদ্মাপাড়ের মানুষ। ১৮৫০-এর দশকের মাঝামাঝিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙনে সব হারিয়েছিলেন তাঁরা। প্রাণ হাতে নিয়ে শুরু করেছিলেন নতুন যাত্রা। ১৮৫৬ সালে জলবায়ু শরণার্থী হয়ে বিহারে পৌঁছে থেমেছিল সে চলা। অনেক দিন ধরেই লেখক থাকছেন নিউইয়র্কে। কলকাতায় যাতায়াত করেন প্রায়ই। কূটনীতিবিদ পিতার চাকরির সুবাদে অমিতাভ ঘোষ শৈশবে ছিলেন বাংলাদেশে। দুই দশক ধরে তাঁর লেখায় নানা প্রসঙ্গে উঠে আসছে সুন্দরবনের কথা। বর্তমানের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক তৈরি অমিতাভ ঘোষের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রাসঙ্গিকতা লেখকের সাম্প্রতিক সময়ের ভাবনার মূল বিষয়। 

সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন ভারতের ৫৪তম জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। ইন্ডিয়ান রাইটিং ইন ইংলিশের অন্যতম এই লেখক তারও আগে পেয়েছেন ভারতের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী এবং ড্যান ডেভিডের মতো গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা। অমিতাভ ঘোষের সব শেষ বই গান আইল্যান্ড।

সুন্দরবন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সাহিত্য নিয়ে ৩ জুন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে জুমের মাধ্যমে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাদিয়া: এক যুগ আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বলতে গেলে এটি বাংলা ভাষায় দেওয়া আপনার প্রথম সাক্ষাৎকার।

অমিতাভ ঘোষ: ২০০৮ এ বাংলাদেশে কয়েক দিন ছিলাম। এর আগে ছোট একটা সাক্ষাৎকার বাংলায় দিয়েছিলাম ভারতে। তবে সে বহু বছর আগের কথা। সে অর্থে এটাই বাংলায় দেওয়া প্রথম পুরোপুরি একটা সাক্ষাৎকার।

সাদিয়া: শৈশবে বাংলাদেশে ছিলেন। গতবার এসে পুরান ঢাকায় গিয়েছিলেন।

অমিতাভ: ছেলেবেলায় কিছুদিন ছিলাম বাংলাদেশে। পুরান ঢাকার কথা কে বলল?

সাদিয়া: ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মূল চরিত্র ত্রিদিব জিন্দাবাহারে নিহতসহ বেশ কিছু প্রসঙ্গের বর্ণনা দিয়েছেন আপনার ছায়ারেখা (দ্য শ্যাডো লাইনস) বইতে। ধারণা করছি, লেখকের নিজেরও পুরান ঢাকার সঙ্গে একটা যোগ ছিল।

অমিতাভ: আপনি তো শ্যাডো লাইনসে উল্লেখ করা সেই বাড়ি খুঁজে বের করেছিলেন। একটা ছবি পাঠিয়েছিলেন আমাকে।

সাদিয়া: আলোচনা আসলে শুরু করতে চেয়েছিলাম ‘আম্পান’ নিয়ে। কাকতালীয় যে আজই আবার মুম্বাইয়ে একটা ঝড় আঘাত আনল।

অমিতাভ: মুম্বাইয়ের মানুষ আজ ভাগ্যবান। সেভাবে কিছু ধ্বংস হয়নি। ঝড়ের এই ‘নিসর্গ’ নামটি সুন্দর, তাই না?

সাদিয়া: ঝড়ের নামটি বাংলাদেশের দেওয়া। নিসর্গ তেমন ক্ষতি করেনি, তাও প্রায় এক লাখ মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালের অনেক রোগীও আছেন, যাঁরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত। আজই আপনার ভয়ানক অপ্রকৃতিস্থতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং যা চিন্তার অতীত (দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট: ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য আনথিংকেবল) বইটির পাতা ওলটাতে গিয়ে চোখে পড়ল একটি বাক্য। আপনি আরও কত দিন আগেই লিখেছিলেন, ‘যদি ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বা তারও বেশি বাতাসের গতি নিয়ে চার বা পাঁচ স্তরের একটা ঝড় মুম্বাইতে আছড়ে পড়ত, তাহলে কী ঘটতে পারত?’

অমিতাভ: হ্যাঁ, লিখেছিলাম। আজকের ঝড়টা আসলে সাউথের দিকে এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু যদি আরেকটু এদিক-ওদিকে যেত, তাহলে কী ক্ষতিটাই না হতে পারত! তবে ঝড়টা প্রথম থেকেই ক্যাটাগরি ওয়ানেও পৌঁছায়নি। আমাদের দিকের যেসব ঝড় দেখেছি, সেটার মতো নয়। কিন্তু ও রকম একটা ঝড় যেতে পারত মুম্বাইয়ের দিকে। ঝড়ের গতিবেগ নিয়ে একটা কথা বলা দরকার। ক্যাটাগরি ওয়ান আর ক্যাটাগরি থ্রি, ফোর, ফাইভ—এসবের মধ্যে পার্থক্যটা দ্বিগুণ-তিন গুণ, ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। তফাতটা হচ্ছে একেবারে এক্সপোনেনশিয়াল (ক্রমশ ঊর্ধ্বতর হারে)। ক্ষতির দিক থেকেও তাই। হাওয়াগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। আমার মুম্বাইয়ের বন্ধুবান্ধব অনেক বেশি বেঁচে গিয়েছে আজ।

সাদিয়া: বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, মানে আপনার ভাটির দেশ (দ্য হাংরি টাইড) বইতে উল্লেখ করা বুড়ি গোয়ালিনীর কাছাকাছি কয়েকটি স্থানে আম্পানের দুই সপ্তাহ পর এখনো এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানকার মানুষকে এক কলস খাবারের পানি আনতে জোয়ার-ভাটা উপেক্ষা করে কয়েক মাইল গলাপানি অতিক্রম করতে হয়।

অমিতাভ: প্রতিটি বড় ঝড়ের পরই এই একই অবস্থা হয়। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিও কোথাও কোথাও এমন। দুই সপ্তাহ পরও বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ নেই, পরিস্থিতি অনেক খারাপ।

সাদিয়া: করোনা সংক্রমণের মধ্যে সুন্দরবনের মানুষের সংগ্রামটা আরও বেশি। সুন্দরবনকে আরও বাড়তে দেওয়ার জন্য কী করা প্রয়োজন?

অমিতাভ: মনে করুন ঢাকা ও কলকাতার মানুষের ঢাল হিসেবে সুন্দরবন নেই। তাহলে ক্ষতির মাত্রাটা ভাবুন! কিন্তু জানা কথা যে সুন্দরবন আস্তে আস্তে ডুবছে। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে বলে প্রান্তীয় স্থলভাগটা দ্রুত কমে আসছে। নোনতা জল ঢুকছে, আরও বেশি ঢুকবে। এর সব কটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। অথচ সুন্দরবনই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

সাদিয়া: সুন্দরবন রক্ষায় উপকূলীয় মানুষকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে আনা উচিত?

অমিতাভ: আসলে জানেন, এ বিষয়ে আমার বলতে একটু ভয় করে। ইন্ডিয়াতে দেখেছি, সরকার এসব ব্যাপারে নেমে গেলে খারাপ ফলও হতে পারে। হাংরি টাইড বইয়ে উল্লেখ করেছি, মরিচঝাঁপির ঘটনা সম্পর্কে আপনিও জানেন। উদ্বাস্তু মানুষ সেখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু যেহেতু সেটা সরকারি নির্দেশে ঘটেনি, ফলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটল। সরকারও তো প্রথমে চাইছিল ওখানকার মানুষদের সরিয়ে দিতে। ওরা তো সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছিল। মরিচঝাঁপির ঘটনাটা গণহত্যাই বলব। আমার মনে হয় সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে সেখানকার মানুষদের পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে আনার বিষয়টা সিভিল সোসাইটির হাতে দেওয়া উচিত। আবার ওখানকার যেসব স্থানীয় মানুষ আছে, তাদের নিজেদেরও পরিকল্পনা করা উচিত। তবে ওরা করছেও কিন্তু পরিকল্পনা। যারা সুন্দরবনের উপকূলে একেবারে সামনের সারির, বলতে পারেন, তাঁরা অনেকেই এখন অন্য জায়গায় বাড়ি করছে, ছোট ছোট জমি কিনেছে। এভাবে আস্তে আস্তে নিজেরাই অনেকে সুন্দরবনের কাছ থেকে সরে আসছে। দেখুন, যারা সুন্দরবনের কাছে থাকে, তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তারা দেখছে এবং আমাদের চেয়ে বেশি বুঝতে পারে যে কী হতে যাচ্ছে।

সাদিয়া: জলবায়ুঝুঁকি মোকাবিলায় শুধু সিভিল সোসাইটির উপদেশ কার্যকর? যাঁরা এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, তাঁদের মতামতও তো নেওয়া উচিত।

অমিতাভ: একদম ঠিক বলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা যে শুধু বৈজ্ঞানিকেরা জানেন, তা তো নয়। আমাদের দেশে যারা সেভাবে সমুদ্রের কাছে থাকে, নৌকা নিয়ে বের হয়, তারা খুব ভালোভাবে জানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী হচ্ছে, না হচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিকল্পনার জন্য সেটা শোনা প্রয়োজন। ট্র্যাজেডি যে আমরা শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো পড়ি আর বিজ্ঞানীদের কথা শুনি। সাধারণ মানুষের কথা শুনি না। বিজ্ঞানীরা একটা শ্রেণি, যাঁদের সেই অভিজ্ঞতাটা নেই, যেটা একজন চাষি বা জেলের আছে। তাদের অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা। সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

অমিতাভ ঘোষের সর্ব শেষ বই ’গান আইল্যান্ড’
অমিতাভ ঘোষের সর্ব শেষ বই ’গান আইল্যান্ড’


সাদিয়া: এখন পর্যন্ত আপনার সবশেষ বই বন্দুক-দ্বীপ (গান আইল্যান্ড)। এ বইটি ভবিষ্যতের অমোঘ ইঙ্গিতবাহী বলছেন অনেকেই। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এমন কিছু প্রসঙ্গ আছে, যা এখন দ্রুত ঘটছে। এর মধ্যে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেদিন লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন নিহত হয়েছেন। এসব প্রসঙ্গ আপনার বইয়েও এসেছে। এই অভিবাসন শুধুই আর্থিক বৈষম্যের কারণে হচ্ছে, নাকি এটা একটা ঝোঁক?

অমিতাভ: শুধু আর্থিক তো নিশ্চয়ই নয়। এই ধরনের অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে হবে, বাংলাদেশিদের একটা বিরাট গ্লোবাল নেটওয়ার্ক আছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে সেটা হয়ে আসছে কিংবা তার আগে থেকেও হতে পারে। অনেক বাঙালি একসময় লস্করের (জাহাজের কর্মী হিসেবে) কাজ করতেন। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী হয়ে যেতেন। আপনি হয়তো শুনেছেন, বেঙ্গলি হারলেম নামটা? খুব ইন্টারেস্টিং বই। অনেক বাঙালি নিউইয়র্ক সিটিতে, নিউ অর্লিয়েন্সে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক বছরের ফলে তাঁরা সেখানে মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। কিন্তু সেই যোগাযোগগুলো থাকার কারণে তাঁরা অনেককে আনতেও পেরেছেন। ধরুন যেভাবে রয়েছে বিলেতে, সিলেটিরা কেমন করে গেছেন ইত্যাদি। ভেনিসের সম্পর্কে বলতে হবে যে ওখানে একটা বাঙালি সেটেলমেন্ট নাইনটিন ফোরটিজ থেকে হচ্ছে। ওখানে অনেক শিপইয়ার্ড আছে। সেখানে তাঁরা কাজ শুরু করেন। আস্তে আস্তে এই যোগাযোগগুলো আরও বেড়েছে, গভীর হয়েছে, ফলে আরও মানুষকে টেনে এনেছে।

আজকালকার দিনে কী হয়েছে জানেন তো? এই যে সেলফোনের কমিউনিকেশন, এরও একটা বিরাট ভূমিকা আছে অভিবাসনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ শতভাগ সেলফোনের আওতায়। সবার কাছেই বোধ হয় একটি বা দুটি করে স্মার্টফোন আছে। এমনকি সুন্দরবনের অনেক ভেতরেও নেটওয়ার্ক আছে। খুব সস্তায় পাওয়া যায় আর সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা তথ্য দেখে অনেকে। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্য ভাই বা চাচা গিয়েছে, তাদের ছবি দেখে সেখানকার। ওই থেকে ভেতরে একটা ইচ্ছার জন্ম নেয়, আমিও যাব। তাদের ওপর একটা আর্থিক চাপও থাকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিও সামলাতে হচ্ছে।

ইতালিতে আমি এমন অনেক বাঙালির সঙ্গে কথা বলেছি। বুঝেছি, এটা একটা জটিল মানসিক ব্যাপার। এর অনেক ব্যাখ্যা আছে। শুধু একটা প্রসঙ্গ দিয়ে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি বলব, ক্লাইমেট চেঞ্জ, প্যানডেমিক এবং মাইগ্রেশন—এ সব কটির ভেতরে কোথায় যেন একটা কানেকশন আছে। সেই কানেকশনটা হলো, এই আধুনিক জগতে সবকিছুই শুধু ছুটছে। দ্রুত বাড়ছে গতি। এ জন্য অভিবাসন বা অবৈধ অভিবাসনের ঝোঁক বা সুযোগও বাড়ছে।

সাদিয়া: বছর দুই আগে কলকাতায় আপনি আমাকে প্রথম প্রশ্ন করেছিলেন বাংলাদেশের অভিবাসন সম্পর্কেই। তখন বন্দুক-দ্বীপ বই লিখছিলেন।

অমিতাভ: তখন ইতালির অভিবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে কলকাতায় এসেছিলাম। বুঝতে চাইছিলাম, বাংলাদেশ এত ডায়নামিক কিন্তু তরুণেরা কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এত বেশি অনুপ্রবেশের দিকে ঝুঁকছে?

সাদিয়া: মানুষই জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক বড় কারণ, আবার মানুষই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর সব মানুষ অতিমারির ভয়ে এক আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের পর ইতিবাচক পরিবর্তন হবে মনে হয়?

অমিতাভ: আমার তো মনে হয়, এই সচেতনতা এরই মধ্যে এসে গেছে। ইতালিতে আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা খুব সাধারণ ঘরের, লেখাপড়া তেমন করেনি। কিন্তু তারা সব্বাই এই করোনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। জলবায়ু পরিবর্তন কোন ধরনের প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কেও তারা খোঁজখবর রাখে। বিশেষ করে বাংলাদেশে তো সরকারের পক্ষÿথেকে অনেক তথ্য দেওয়া হয়। আপনাদের বেশ কিছু ভালো এনজিও আছে, যারা তথ্য দিচ্ছে এবং সচেতন করছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। এমনকি সচেতনতার দিক থেকে ভারতের চেয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে মনে হয়। আজ যখন ঝড়টা মুম্বাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল, তখন ওখানেও একটা বিরাট আগ্রহ জেগে উঠেছে।

আপনাকে আজই বলছিলাম না যে সকাল থেকে আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি ইন্ডিয়ার বিভিন্ন টেলিভিশনকে? হঠাৎ সবাই খুব যেন নড়েচড়ে বসেছে। এখন সবাই বুঝতে পারছে যে এই ঝড়গুলো একেবারে দুয়ারের ওপরে এসে পড়ছে।

সাদিয়া: গান আইল্যান্ড বইয়ের মধ্যে এমন কিছু বিষয় ছিল, যা এখন বর্তমানে ক্রমাগত ঘটে চলেছে। একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন কুকুরের সাপ খেয়ে মৃত্যুর ঘটনার। জলবায়ু পরিবর্তনেরই কারণ ছিলে ওটা আপনার বইয়ে। বাংলাদেশেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে কিছুদিন আগে। গাজীপুরের সাফারি পার্কে সাপ খেয়ে একটা বাঘ মারা গেছে। লেখকের এই যে আগে থেকেই ধারণা করতে পারা, এটা কি তাঁর চর্চার ফল?

অমিতাভ: আপনি কী বললেন? সাপ খেয়ে বাঘ মারা গিয়েছে! ও বাবা, তাহলে নিশ্চয়ই খুব বিষধর কোনো সাপ ছিল। এটা সত্যি ঘটনা?

তাহলে আপনাকে একটা মজার গল্প বলি। গান আইল্যান্ড বইয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ভয়ানক দাবানলটার কথা মনে আছে? ওই অংশটুকু আমি যখন লিখেছি, তখনো কিন্তু দাবানলটা হয়নি। সত্যি এক বছর পর ওখানে এমন আগুন লাগল। এটা কী হয় জানেন? আসলে কল্পনা। চারপাশে যা ঘটে চলেছে, সেটা সম্পর্কে মানুষ যদি ভাবে বা সচেতন থাকে, তাহলে অনেক কিছু আগে থেকে আন্দাজ করা সম্ভব। যেমন আপনি ভয়ানক অপ্রকৃতিস্থতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং যা চিন্তার অতীত বা গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট বইয়ের একটা অংশে লেখা মুম্বাইয়ের ঝড়টার কথা আজ পড়লেন। কত বছর আগে লেখা অথচ কথা বলার সময় সে ঘটনা আজ আবার ঘটে গেল।

সাদিয়া: অতিমারি, জলবায়ু পরিবর্তন—এসব মিলে আপনার মনে হয় পোকামাকড়দের দ্রুত মাইগ্রেশন হবে?

অমিতাভ: সে তো হচ্ছে। শুধু পোকামাকড় নয়, সবকিছু মাইগ্রেট করছে। শুধু মানুষ নয়, গাছপালা, এমনকি ফসলও মাইগ্রেট করছে। সিসিলিতে এখন কী হচ্ছে? সিসিলি এখন আস্তে আস্তে সাহারা মরুভূমির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের পুরো পরিবেশটাই পাল্টে যাচ্ছে। সবকিছু বদলাচ্ছে, পুরো পৃথিবীর আবহাওয়ায় বড় পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা যখন কথা বলছি, তখন গালফ অব মেক্সিকোতে আরেকটা ঝড় আসছে। এ সময় সেখানে ঝড় হওয়া উচিত নয় কিন্তু তিনটা ঝড় হয়ে গেল।

সাদিয়া: আপনার গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট বইটিতে আক্ষেপ করে বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থিত। কিন্তু বর্তমান সাহিত্যে অনুপস্থিত থাকছে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে একেবারে অনুপস্থিত। এ প্রসঙ্গে আরেকটু সহজ করে বললে ভালো হয়।

অমিতাভ: যদিও আমি বাংলা সাহিত্যের বিদ্বান নই, তবু আপনি যদি বলেন এটা, তাহলে মেনে নেব। দেখুন, অদ্বৈত মল্লবর্মন বা মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের বইয়ের মধ্যেও কিন্তু এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এখন যদি তা অনুপস্থিত হয়, তাহলে তা গত ২০, ৩০ বছরের মধ্যে ঘটেছে। যেমন হচ্ছে ইউরোপ বা আমেরিকাসহ বিভিন্ন জায়গাতেও। কেন হচ্ছে, জানেন? আমরা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি যে কোথায় বাস করছি আর এই পৃথিবীর ওপরই আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ভুলে যাওয়াই সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অনুপস্থিত থাকার মূল কারণ।

সাদিয়া: আপনি কিন্তু অনেক লেখায় এর পেছনে কল্পনাশক্তির খামতির কথাই বলেছেন। যেমন গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট বইয়ের মধ্যে স্পষ্ট বলেছেন, জলবায়ুর সংকট সংস্কৃতির সংকটও বটে এবং সেই কারণেই কল্পনাশক্তিরও।

অমিতাভ: তো একদমই ঠিক। আমাদের কল্পনাশক্তি একটা দিকে চলে গিয়েছে। ধরুন, আপনি যদি পুরোনো বাংলা সাহিত্য দেখেন, চাঁদ সওদাগরের গল্প, সে তো পুরোটাই প্রকৃতিনির্ভর। ওই গল্পের ভেতরেই আছে প্রকৃতি, মঙ্গলকাব্যেও প্রকৃতি। আজকাল আসলে আমাদের কল্পনার শক্তিটাই বদলে গেছে। তবে শুধু লেখকদের কথা বলব না, সাংবাদিক বা শিল্পীরাও তো এখন প্রকৃতি নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। শিল্পীরা খুব বেশি অ্যাবস্ট্রাক্ট শিল্পের দিকে যাচ্ছেন। আমরা আসলে প্রকৃতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি কিন্তু এখন আবার সেদিকে মুখ ফেরাতে হবে।

সাদিয়া: এ সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? লেখায় অনেক কিছু দৈবের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। এমনকি অতীতের দিকে তাকাতে বলেছেন, গান আইল্যান্ড বইয়ে লিখেছেন মানুষের উদ্ধারের জন্য যেতে হবে উৎসের কাছে।

অমিতাভ: মানুষ শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। বলতে চেয়েছি, যদি আমাদের কোনো উদ্ধারের উপায় আসে, তাহলে তার ইঙ্গিত অতীত ইতিহাসে আছে। তাই আমাদের শুধু সামনে নয়, পেছনের দিকেও দেখতে হবে।

সাদিয়া: মনসা দেবীর মিথকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনের সঙ্গে গোটা বিশ্বের একটা যোগসূত্র তৈরি করেছেন, এমনকি ভেনিস পর্যন্ত।

অমিতাভ: অপরিচিত হোক বা চেনা মানুষ, আমরা প্রত্যেকেই সংযুক্ত। আর সে যোগাযোগ কিন্তু ভীষণ গভীর আর দিন দিন মানুষের এই সংযোগ আরও গভীর হচ্ছে। দেখুন, আমি এখন ঠিক যেখানে বসে আছি, সেখানে নিউইয়র্কে রোজ সন্ধেবেলা শুরু হচ্ছে বিক্ষোভ-আন্দোলন। এগুলো আমার অন্তত খুবই চেনা চেনা লাগছে এখন। কাল একটা পোস্টার দেখলাম, খুব ভালো লাগল। লেখা ছিল, Bengalis for black lives matter. এখানকার অনেক বাঙালি কিন্তু খুব সমর্থন করেছে। কয়েক জায়গায় ভাঙচুরও হচ্ছে, তবে সেদিকটা কমে আসছে আর আন্দোলনটা ছড়াচ্ছে ছোট ছোট জায়গাতেও।

সাদিয়া: বাংলাদেশে আপনার অনেক পাঠক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে আপনার দ্য শ্যাডো লাইনস আর হাংরি টাইড পাঠ্য।

অমিতাভ: আপনার কাছ থেকেই শুনেছি। জেনে আমার সত্যি খুব ভালো লাগল। আমার আসার কথা বাংলাদেশে, তবে পরিস্থিতি যেমন হচ্ছে, বুঝতে পারছি না আদৌ কতটা সম্ভব হবে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে একটু সংশয়ই হচ্ছে। আজ মুম্বাইয়ের ঝড়টা দেখুন কেমন আকস্মিক এল। কিছুই আগে থেকে ধারণা করা যাচ্ছে না এখন।

সাদিয়া: প্রথম আলোকে এতটা সময় দিলেন বলে আন্তরিক ধন্যবাদ।

অমিতাভ: আপনার সঙ্গে তো আগে থেকেই সময়টা ঠিক হয়েছিল। ঝড়টা নিয়ে আমি আর অ্যাডাম সোবেল লিখেছিলাম কয়েকটি লেখা।

সাদিয়া: অ্যাডাম সোবেলের ঝড়ের প্রবন্ধে সময় নিয়ে মনে হয় একটা ভুল তথ্য ছিল, যেটা নিয়ে কেউ কেউ সংশোধন করে টুইটারে পোস্ট দিয়েছেন।

অমিতাভ: হ্যাঁ। অ্যাডাম আবার ওটা সংশোধন করেছেন। বলেছিলেন, মুম্বাইয়ের মৌসুমি ঝড়টা গত ১২৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়। পরে আবার সংশোধন করে বলেছেন, ফোরটিজের দিকে আরও বড় ঝড় হয়েছিল।

সাদিয়া: লেখককে নিজের লেখা বহুবার সংশোধনের জন্য ধৈর্য রাখতে হয় বলছিলেন। আপনি পুরো লেখাটা নিয়ে আগে পরিকল্পনা করে তারপর শুরু করেন?

অমিতাভ: লেখককে বারবার সংশোধনের সুযোগ নিজেকেই দিতে হয়। আর অনেক বড় লেখকদের কথা শুনেছি যে তাঁরা পুরোটা পরিকল্পনা করে, ছক কষে তারপর লেখেন। কিন্তু আমি সেভাবে ঠিক পারি না। একটা ভাবনা তো থাকেই নিজের। কিন্তু ছক করে লিখি না।

সাদিয়া: বাংলাদেশের পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও সাহিত্য প্রসঙ্গে?

অমিতাভ: কোভিড পরিস্থিতিতে সবাই অনেক সময় পাচ্ছেন বই পড়ার। জলবায়ু পরিবর্তন ও ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করুন এবং সেসব নিয়ে লেখার প্রস্তুতি নিন। লেখককে অনেক বেশি পড়তে হয়।

সাদিয়া: ধন্যবাদ। নিরাপদে থাকুন আপনি।

অমিতাভ: আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের পাঠকদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারাও সবাই নিরাপদে থাকবেন।