বরাদ্দ অর্থের ফলপ্রসূ ব্যবহার কীভাবে হবে

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বাজেট ঘোষণার আগেই এই পত্রিকায় কৃষি বাজেট নিয়ে আমার দুটো লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে আমার কিছু প্রস্তাব ও পরামর্শ ছিল। এই লেখায় আমি কৃষি বাজেট বরাদ্দ, বাজেটের ঝোঁক ও বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে আরও কিছু আলোকপাত করতে চাই।

১. বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, এতে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ধরা হয়েছে। ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার একটি বড়সড় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) রয়েছে। ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও পানিসম্পদ মিলিয়ে ২৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত বছরের সংশোধিত বাজেট থেকে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। কেবল কৃষি খাতে এবারের বাজেট বরাদ্দ সংশোধিত বাজেট থেকে ২ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি। ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি রয়েছে, যা মূলত সার ও সেচের জন্য ব্যবহার করা হবে। এর সঙ্গে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার স্বল্প সুদে পুনঃ অর্থায়নের ব্যবস্থার ঘোষণাটি যথেষ্ট ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যাংক চ্যানেলের জমি বন্ধকিনির্ভর কৃষিঋণ বিতরণজনিত জটিলতার কারণে এসব টাকা কৃষকের কাছে সময়মতো সঠিকভাবে পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকেই যাবে।

২. বরাদ্দ বাজেট সময়মতো খরচ করতে পারলে তা ঠিকই আছে। সে জন্য কৌশল উন্নয়নের কথা বলছি। উন্নত মানের বীজ ও অন্যান্য উপকরণ, কৃষিযন্ত্রসেবা ও কৃষিঋণ—এসবের মানোন্নয়নের জন্য অনুসৃত কৌশলে নতুনত্ব প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণে বিএডিসিকে আরও তৎপর ও গতিশীল হতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএডিসির রয়েছে বীজ উৎপাদন খামার, প্রায় সাড়ে চার হাজার একর জমি, চুক্তিবদ্ধ বীজ উৎপাদন অঞ্চল, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণকেন্দ্র এবং অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত জনবল। তারা ত্রিমুখী কৌশল নিয়ে এগোতে পারে। সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো এবং বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন। ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হাতে বহু উন্নত জাতের উফশী বীজ ও হাইব্রিড বীজের পিতৃ-মাতৃ সারি রয়েছে। গম ও ভুট্টা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হাতে হাইব্রিড-১৬ জাতের ভুট্টার পিতৃ-মাতৃ সারি আছে। কিন্তু এসব বীজ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের যথেষ্ট জমি নেই। বিএডিসি নিজের জমিতে এসব বীজ আরও বেশি করে উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারে। সবজি ও অন্যান্য ফসলের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। প্রয়োজনে বিএডিসি এসব সংস্থা এবং বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে কাজ করতে পারে। এতে কৃষক লাভবান হবে, বীজ আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং খাদ্যশস্যের বীজের জন্য বিদেশনির্ভরতা কমবে। সর্বোপরি কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়বে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৭০-৮০–এর দশকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি-সরকারি সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ আণবিক কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এক-দেড় শ একর জমি ছেড়ে দিয়েছিল; এ দুটো প্রতিষ্ঠান উন্নত জাতের মাছের পোনা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন করে আসছে।

৩. কৃষিঋণ বিতরণ সমস্যার সমাধান করতে হবে। ঋণ পাওয়া কৃষকদের একটা বড় অংশ আগের ঋণ সুদে-আসলে শোধ করতেই শেষ হয়ে যায়, তঁাদের হাতে নগদ খুব কমই থাকে। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র কৃষকের জমি বন্ধকিসহ অন্যান্য শর্ত পূরণের সহজ ও বিকল্প পন্থা প্রয়োজন। এনজিও-ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো উচ্চ হারের সুদসহ কীভাবে জামানতের বিষয়টি সমাধান করে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে, তার আলোকে সরকারি কৃষিঋণ বিতরণের গতি ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের কৃষিনীতিতে পিকেএসএফের আদলে একটি ‘কৃষিঋণ ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখনো সে রকম করা যেতে পারে। এবার করোনার ঝুঁকির মুখেও কৃষকেরা যেভাবে উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন, তার প্রতিদান হিসেবে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকার ‘প্রধানমন্ত্রীর কৃষক উদ্দীপনা ফান্ড’ নামে বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাবটি বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হোক।

৪. কৃষি যান্ত্রিকায়ন বিষয়ে। এবারের বাজেটে এ জন্য ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এডিপিতে রাখা হয়েছে। এখানেও যথেষ্ট কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, প্রকল্পটিকে গতানুগতিক ধারার পরিচালনার মধ্যে আটকে না রেখে যথাযথ প্রকৌশল-অভিজ্ঞতার সমাহার ঘটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পের টাকা কখন কীভাবে কাজে লাগালে সর্বোচ্চ সুফল আসবে, তার একটি সুচারু পথনকশা তৈরির কাজ এখনই শুরু করতে হবে, যাতে আগামী মৌসুমে ব্যবহার্য কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। বেসরকারি খাতের যন্ত্র সরবরাহকারীরা যাতে আগেভাগেই চাহিদা অনুযায়ী তাদের আমদানি অর্ডার পাঠাতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষকেরা বড় যন্ত্র কেনার টাকা জোগাড় করতে পারেন না, সরবরাহকারীদের যন্ত্র বেচতে হয় বাকিতে। এভাবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে আর্থিক চাপে পড়ে। আর যন্ত্র সরবরাহকারীরা বিক্রয়োত্তর সেবা দিতে বেশি মনোযোগী হবে। তারা ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কাজে জড়িত হবে, এটা কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে কৃষিঋণের একটা অংশ অবশ্যই কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য সুনির্দিষ্ট থাকবে, এমন নির্দেশনা দেওয়া সমীচীন। চতুর্থত, দেশি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারীদের জন্য ঋণ–সুবিধাসহ অনুকূল করনীতি ও প্রযুক্তি সুবিধার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পঞ্চমত, সফল যান্ত্রিকায়নের জন্য মেকানিক, ড্রাইভার, মেটাল ওয়ার্কশপ ইত্যাদির জন্য প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণেরও সুযোগ রাখা উচিত।

৫. কৃষি বাজেটে কৃষকের পণ্য বিপণন ও লাভালাভের বিষয় গুরুত্ব পাওয়ার কথা। এ লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বিপণন অধিদপ্তর জোরদারকরণ ও এর কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করার কর্মসূচি নিয়েছে। লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষিপণ্যের বাজার দাম জোগাড় করাই যথেষ্ট নয়। দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজার তথ্যের বিশ্লেষণ, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও দামের আগাম সংকেত প্রদানসহ কৃষিপণ্যের সঠিক মূলনীতি প্রণয়ন করে নিয়মিত পরামর্শদানের জন্য একটি শক্তিশালী ‘কৃষি মূল্য কমিশন’ গঠন করা উচিত। এমন প্রস্তাব প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ১৯৯৯ সালের জাতীয় কৃষিনীতিতে ছিল। বিষয়টি এবারের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

৬. বাজেটে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা প্রশংসনীয়। পোলট্রি, মাছ ও দুগ্ধ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় পশুখাদ্য ও ওষুধ কিনতে। ফসল খাতে যেমন সার, বীজ, সেচে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, পশুখাদ্যের দামেরও কিছুটা ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখলে খামারিরা আরও উৎসাহ পাবেন।

৭. সবশেষে বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রা বহুলাংশে নির্ভর করছে খাদ্যশিল্পের উন্নয়নের ওপর। বাজেটে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ সৃষ্টি করেছে। সেটা প্রধানত রেগুলেটরি দিকগুলো দেখবে। কিন্তু কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন করে দেশেই মানসম্পন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

মনে রাখতে হবে, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও আয় বৃদ্ধির ফলে তৈরি প্যাকেটজাত খাবারের চাহিদা বাড়ছে। জনগণের খাদ্য-পুষ্টির নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে খাদ্যশিল্পের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এ বাজেটে খাদ্যশিল্পে কীভাবে আরও বিনিয়োগ বাড়বে, সে সম্পর্কে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজি সংস্থান ও করকাঠামো সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকা সংগত হবে।

এম এ সাত্তার মণ্ডল: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য