মা তোমায় সালাম

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

চুয়াত্তরের অক্টোবর হবে। বেশ বৃষ্টি ছিল। দেশের বন্যা পরিস্থিতি, খাদ্যাভাব, জাসদ আরও কিছু বিষয় নিয়ে শরীফের বেড়ার ক্যানটিনে তর্ক চলছে তুমুল। গা গা করতে করতে লাল মোটরসাইকেল ছুটিয়ে সেলিম এসে এক কড়া ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল ক্যানটিনের দোরগোড়ায়। মোটরসাইকেলের বিরক্তিকর আওয়াজে থেমে যায় সব খুচরা আলাপ। কেউ কেউ বিরক্তও হয়।

তবে সেলিম সবার চেনা সবার বন্ধু। ’৭১-এ ঢাকার ক্র্যাকপ্লাটুনের কনিষ্ঠ সদস্য ছিল এই সেলিম আকবর (এ বছরের ১৫ এপ্রিল তিনি মারা গেছেন)। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই ডানপিটে বন্ধু ইশারায় ডেকে নিল ক্যানটিনে বসে থাকা আমাদের দুজনকে। তারপর যেমন উড়ে এসেছিল, তেমনি উড়ে ছুটল নীলক্ষেত বলাকা সিনেমা হল হয়ে এলিফ্যান্ট রোড। হোটেল কাম্পালার (এখন নেই) সামনে এসে একটা পান কিনল সেলিম। জর্দা নিল একটু। দুই–তিনবার চিবিয়ে ফেলে দিল মুখের পান। তখনো আমরা জানি না আমরা এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের দর্শনে যাচ্ছি।

জাহানারা ইমাম নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। আগস্টে সেলিম বলেছিল নিয়ে যাবে একদিন। নিয়ে এল অক্টোবরের ৩ তারিখে, নোটিশ ছাড়া, ভরদুপুরে। তিনি কি জানতেন আমরা তিন অভুক্ত তাঁর খাওয়ার সময় তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হব? তিনি কি সব সময় একটু বেশি করে চাল নিতেন পাতিলে? থাকত মাছের বাড়তি টুকরা? তিনি কি রান্নার সময় রুমিদের কথা মনে করে এসব করতেন? যদি রুমি বন্ধুদের নিয়ে এসে পড়ে ঠিক খাওয়ার সময়?

চুয়াত্তরের জুনে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অক্টোবরে আমি যেন আমার মাকেই দেখলাম। কীভাবে বুঝলেন তিনি আমরা ভাত খাইনি তখনো? সেলিমের দিকে একবার একটু শাসনের চোখে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘এখনো তুমি সিগারেট ছাড়োনি?’ আমরা বুঝলাম কেন সেলিম রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পান-জর্দা মুখে দিয়েছিল। তারপরও লুকাতে পারেনি মায়ের কাছে। মায়েরা এমনই হন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে কি সালমাদের বাসায় দেখেছি?’ এলিফ্যান্ট রোডের আরেক ট্র্যাজেডি ডা. আজহার। মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ছিলেন। আলবদররা ধরে নিয়ে খুন করে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাঁর স্ত্রী সালমা আপার বাসায় জাহানারা ইমামকে প্রথম দেখি, পরিচয় হয়নি তখন। ভাত খেতে খেতে পরিচয় নিলেন, পরিচয় দিলেন।

১৯২৯ সালের ৩ মে ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন জাহানারা ইমাম। কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করে কলকাতার লেডি ব্রাবোন কলেজ থেকে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। স্বামী শরিফুল ইমামের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন ১৯৪৮ সালে। শিক্ষকতা দিয়েই তাঁর কর্মজীবনের শুরু। প্রথমে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলে, পরে ১৯৫২ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। রুমির জন্ম হয় ১৯৫১ সালে। রুমিই তাঁর প্রথম সন্তান। একাত্তরে মাত্র ১৯ বছরের তরুণ। শুনতে শুনতে আমাদের গলা শুকিয়ে যায়। ভাত আর গলা দিয়ে নামে না, তিনি টের পান। রুমি প্রসঙ্গ থেমে যায়। তাঁর বিদেশ যাওয়ার গল্প বলেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন তিনি ১৯৬৪-৬৫ সালে। সেলিম তাঁর ডায়েরির কথা তোলেন। ছাপার কথাও ওঠে। ১৯৮১ সালে তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে—তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪২ বছর। শেষ পর্যন্ত সেই বই—‘একাত্তরের দিনগুলি’ ছাপা হয় ১৯৮৬ সালে। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ হৃদয় নিংড়ানো এক মনকাড়া রচনা। বাংলাদেশের জন্মকথার এক অনবদ্য দলিল। তাঁর লেখা আর প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় আছে ‘অন্য জীবন’ (১৯৮৫), ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ (১৯৮৫), ‘জীবন মৃত্যু’ (১৯৮৮), ‘চিরায়ত সাহিত্য: শেক্‌সপিয়ার ট্র্যাজেডি’ (১৯৮৯), ‘বুকের ভিতরে আগুন’ (১৯৯০), ‘নাটকের অবসানে’ (১৯৯০), ‘দুই মেরু’ (১৯৯০), ‘নিঃসঙ্গ পাইন’ (১৯৯০), ‘নয় এ মধুর খেলা’ (১৯৯০), ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ (১৯৯১), ‘প্রবাসের দিনলিপি’ (১৯৯২)।

সবগুলো বই পাঠকসমাদৃত হয়েছে। একাধিক মুদ্রণ হয়েছে অনেকগুলো বইয়ের। তবে ‘একাত্তরের দিনগুলি’র পর বোধ হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’ বইটি। অনেকেই বলেন, তিনি যদি শুধু এ বইটিই লিখতেন, তাহলেও তাঁকে এ দেশের পাঠক মনে রাখত। কথাটায় হয়তো আবেগের বাড়াবাড়ি আছে কিন্তু ক্যানসারে আক্রান্ত প্রতিটি অসহায় রোগী ও রোগীদের নিয়ে চিন্তিত আত্মীয়স্বজনের জন্য একটা অবশ্যপাঠ্য বই এটি। তাঁর ক্যানসার ধরা পড়েছিল ১৯৮১ সালে, এর দশ বছর পর (১৯৯১) প্রকাশিত হয় ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’। বই প্রকাশের চার বছরের মাথায় তিনি মারা যান। নিঃসন্দেহে তাঁর শেষের চার বছরকে এই বইয়ে ধরে রাখতে পারলে আরও ভালো হতো। তারপরও বইটিকে ক্যানসার অসুখের এক সামাজিক দালিলিক বর্ণনা বলা চলে। চিকিৎসা নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট সংস্কার এমন নিখুঁত আর নিরপেক্ষ বর্ণনা কেবল বীর মাতার পক্ষে করা সম্ভব। ক্যানসার ধরা পড়ার পর ২৩ বছর বেঁচেছিলেন জাহানারা ইমাম। মারা যান প্রায় ৬৫ বছর বয়েসে। তখন গড় আয়ু এ রকমই ছিল।

জীবনের বেশির ভাগ সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন ক্যানসারকে সঙ্গে নিয়েই। তাঁর ১৯টা বইয়ের মধ্যে ১৩টাই, বিশেষ করে জনপ্রিয় বইগুলি লেখা এই সময়ে। ক্যানসার হলে আর রক্ষা নাই, মৃত্যু একমাত্র ভবিতব্য, চিকিৎসাচেষ্টা সব বেফুজুল—এই বিশ্বাসে হাল ছেড়ে যদি তিনি হতাশ হয়ে বসে থাকতেন, তাহলে কি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন এবং গণ-আদালত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো? হাল না ছাড়ার আরেক নাম জাহানারা ইমাম। সালাম আপনাকে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
[email protected]