একই সমতলে সুমাইয়া, রুমানা, সাজিদা, তানি...

সুমাইয়া বেগমকে সমাবর্তনের হ্যাট পরিয়ে দেন এক সহপাঠী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। ছবি: সংগৃহীত
সুমাইয়া বেগমকে সমাবর্তনের হ্যাট পরিয়ে দেন এক সহপাঠী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সুমাইয়া বেগমের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল যেদিন জানা গেল, সেদিন আর তিনি বেঁচে নেই। তিনি প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন। এর আগে স্নাতক সম্মানেও প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন। গত সোমবার নাটোরে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। তাঁর মায়ের অভিযোগ, ২০১৯ সালে বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁর পড়ালেখা ও চাকরি করার ইচ্ছা মেনে নিতে পারছিল না। এ কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় ছয় মাস আগেও তাঁকে ঘরে আটকে রেখে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির বিরোধিতা সত্ত্বেও সুমাইয়া পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এর মূল্য তাঁকে দিতে হলো জীবন দিয়ে।

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পড়াশোনা ও চাকরি করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারবেন না; এটি ঠিক করে দেবে তাঁর স্বামীর পরিবার—আমরা কোন সমাজে বাস করছি? সুমাইয়ার হত্যার ঘটনায় স্বামী মোস্তাক হোসাইন, শ্বশুর জাকির হোসাইনসহ চার আসামিই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ জন্য নাটোর পুলিশ ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে আসামি গ্রেপ্তার হওয়া হলেই বিচার নিশ্চিত হয় না। মামলার তদন্ত সুষ্ঠু হতে হবে। সুমাইয়ার বাবা বেঁচে নেই। রাষ্ট্র ও আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ছাড়া মা একা মামলা চালাতে পারবেন না।

২.

সুমাইয়ার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রুমানা মনজুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক ২০১১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় ছিলেন। ছুটিতে দেশে ফিরলে স্বামী হাসান সাঈদ তাঁকে চাপ দেন বিদেশে না যাওয়ার জন্য। রুমানা রাজি না হলে স্বামী তাঁর দুই চোখ নষ্ট করে দেন। তাঁদের একটি মেয়ে ছিল। রুমানা দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (ইউবিসি) তাঁর চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। রুমানা মেয়েকে নিয়ে কানাডায় ফিরে যান। ২০১১ সালেই কারাগারে মৃত্যু হয় হাসান সাঈদের। ২০১৯ সালে রুমানা কানাডার বিচার বিভাগে একজন আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান।

দৃষ্টিশক্তি হারালেও রুমানার ইচ্ছাশক্তি ছিল অদম্য। বিদেশে গিয়ে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। মেয়েকেও পড়াশোনা করাচ্ছেন।

৩.

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি কি বিচার পাব না?’—প্ল্যাকার্ড হাতে বুধবার প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সাজিদা ইসলাম ওরফে পারুল। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদক। যৌতুক, নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যায় অভিযুক্ত সাবেক স্বামী রেজাউল করিম ওরফে প্লাবনের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, আমি যদি সাংবাদিক হয়ে এত দিনেও বিচার না পাই, তাহলে দেশের সাধারণ মেয়েরা কোথায় যাবে?

সাংবাদিক হিসেবে সাজিদা এত দিন অন্য মানুষের নির্যাতনের কথা লিখতেন, তাঁদের দুঃখ-বেদনার কথা পত্রিকায় তুলে ধরতেন। আজ তাঁকেই বিচারের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে? সাজিদার অভিযোগ, ‘কতিপয় সাংবাদিক নেতার প্রশ্রয় এবং পুলিশ প্রশাসনের অবহেলা কাজে লাগাচ্ছে রেজাউল। একদিন দেখবেন, আমাকেই গায়েব করে দেবে সে। তাই, বিচারের দাবিতে আজ একাই দাঁড়িয়েছি।’

আমাদের রাষ্ট্র, পুলিশ প্রশাসন, সাংবাদিক সমাজ কি বধির? তারা কি একজন নির্যাতিত নারী সাংবাদিকের আকুতি শুনতে পাচ্ছে না?

গত ১১ মে হাতিরঝিল থানায় রেজাউলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাজিদা। অভিযোগে বলা হয়, ২ এপ্রিল দৈনিক যুগান্তর–এর স্টাফ রিপোর্টার রেজাউল করিমের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বিয়ের পর যৌতুক হিসেবে রেজাউল করিম ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দাবি করেন ও তাঁর ওপর নির্যাতন চালান। নির্যাতনের কারণে তাঁর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। ৫ মে তিনি রেজাউল করিমের গ্রামের বাড়ি গেলে সেখানেও তাঁকে মারধর করা হয়।

৪.

চতুর্থ ঘটনাটি তাসকিনি ওরফে তানি নামের এক গৃহকর্মীর। মেয়েটির বাড়ি ছিল ঠাকুরগাঁও। ঢাকায় কাজ করত এক সাংবাদিকের বাসায়। এরপর মেয়েটি ওই পরিবারের একজন হয়ে যায়। সে ঘরের নিয়মিত কাজ করার পাশাপাশি ওই পরিবারের একজন প্রবীণ নারীর দেখাশোনা করত। এ জন্য তাকে বাড়তি টাকা দেওয়া হতো। এরই মধ্যে মেয়েটির বাড়তি আয়ের পরিমাণ এক লাখ টাকা হয়। গৃহকর্তা তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মেয়েটির বাবা তাকে বাড়িতে নিয়ে বিয়ে দেবেন বলে জোর করেন। গৃহকর্তা তখন বাবা ও মেয়েকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যৌতুক দিয়ে যেন বিয়ে দেওয়া না হয়। কিন্তু বাবা এক লাখ টাকা যৌতুক দিয়েই মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছিলেন। আর সে ঘটনা জানাজানি হয় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ডায়রিয়ায় মারা যাওয়ার পর। গ্রামবাসী স্বামীর পরিবারকে যৌতুকের অর্ধেক টাকা ফেরত দিতে বলেন। তাঁদের কথা হলো, বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য শেষ সম্বল এক লাখ টাকা জামাইকে দিয়েছেন। টাকা ফেরত না দিলে বৃদ্ধ মা–বাবা কীভাবে চলবেন?

এক অর্থে তানিও যৌতুকেরই শিকার। তবে সাজিদার ঘটনা আরও নির্মম। সাংবাদিক নামধারী রেজাউল যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীর ওপর নির্যাতন করেছেন। আর তানির ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর যৌতুকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ সালিসে বসেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা রিপোর্টে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ বিবাহিত নারী তঁাদের স্বামীর দ্বারা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাঁদের মাত্র ২.৬ শতাংশ অভিযোগ করেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়েছিল, নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি শাস্তি পায় না। মাত্র তিন ভাগ শাস্তি পায়।

২০১০ সালে ঘরে নির্যাতিত নারীর সুরক্ষায় ‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন’ পাস হয়েছে। নারীর নিরাপত্তায় এর আগেও অনেক আইন হয়েছে। কিন্তু ওপরের তথ্য ও ঘটনাবলি প্রমাণ করে না, আইন কার্যকর আছে।

সুমাইয়া, পারুল, তানি, রুমানা। নামগুলো ভিন্ন। ভিন্ন তাঁদের সামাজিক অবস্থান। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। কেউ সাংবাদিকতা করছেন। কেউ বা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁদের অভিন্ন পরিচয় হলো স্বামী বা তাঁর স্বজনদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যৌতুকের বলি হয়েছেন।

বাংলাদেশে ঘরে-বাইরে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ হয়তো রুমানার মতো ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন। অনেকেই পারেননি। অনেকে সুমাইয়ার মতো চিরতরে হারিয়ে গেছেন। অনেকে সাজিদার মতো বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি