ধান-চালের মজুতদারি

করোনা মহামারি শুধু স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ-আশঙ্কার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; গোটা জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সামনে। বিপুলসংখ্যক মানুষ ইতিমধ্যে জীবিকা হারিয়েছে, দেড় কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে ইতিমধ্যে অন্নসংস্থানের কষ্ট বেড়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকট।

এ অবস্থায় দেশের প্রধান খাদ্য চালের দাম সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুই সপ্তাহে সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি এক থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। বরং সদ্য তোলা বোরো ধানের যে ব্যাপক ফলন হয়েছে, তার ইতিবাচক প্রভাবে চালের দাম কমে যাওয়ার কথা। অবশ্য বাংলাদেশে ধান-চালের উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে চাহিদা-জোগানের স্বাভাবিক নিয়মটা কখনোই কাজ করে না। বাম্পার ফলন হলে ধানের দাম কমে যায়, কিন্তু চালের দাম কমে না। এই বিরাট অসংগতির কারণ আমাদের প্রধান খাদ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। চালকলের মালিকেরা ধানের বাম্পার ফলনের সুযোগ নিয়ে ধানচাষিদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে তা থেকে চাল উৎপাদন করেন এবং চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের সুবিধামতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে।

চলমান করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে ধান-চালের বাজারে সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন সমস্যা। আগের চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা তো আছেনই; তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন এক মজুতদার গোষ্ঠী, যারা এই জাতীয় সংকটময় পরিস্থিতিকে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের কাজে লাগানোর সুযোগ নিতে চায়। অর্থনীতিবিদ ও চাল ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক অনানুষ্ঠানিক খাতের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে; কিছু খাতের ব্যবসায়ীরা তাঁদের নিয়মিত ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে সেই টাকায় ধান-চাল কিনে মজুত করা শুরু করেছেন। তাঁদের ভাবনা, সামনের দিনগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্রতর হবে। তার ফলে দাম বেড়ে যাবে এবং তাঁরা প্রচুর মুনাফা পাবেন।

করোনার প্রভাবে ভারতের বাজারসহ বিশ্ববাজারে চালের দাম ইতিমধ্যে বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ, আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবার বেশি হয়েছে। আমাদের বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণ মজুতদারি। বোরো ধান ওঠার পরে এই ভরা মৌসুমে দেশের ধানের বাজারগুলোতে ধান ওঠা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে বলে নওগাঁ এলাকা থেকে খবর এসেছে। এর অর্থ বড় কৃষক, যাঁদের এই মুহূর্তে ধান বিক্রি না করলে সংসার চালাতে সমস্যা হচ্ছে না, তাঁরা এবং নতুন মজুতদার গোষ্ঠী ধান–চাল মজুত করছেন। এর প্রভাবে চালকল মালিক ও চালের ব্যবসায়ীরা পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম প্রতি সপ্তাহে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

এই পরিস্থিতি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। আয়রোজগারহীন মানুষের প্রাণধারণের জন্য মৌলিক খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতা আরও কমে যাবে। অতএব ধান-চালের মজুতদারির মাধ্যমে বাজারকে অস্থিতিশীল করে বাড়তি মুনাফা লোটার এই অপচেষ্টা দমনের জন্য সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মজুতদারি হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য খাদ্য অধিদপ্তর জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয়গুলোতে চিঠি পাঠিয়েছে। খতিয়ে দেখার পরে পদক্ষেপ নিতে যেন বিলম্ব হয়ে না যায়; যেন দ্রুতই মজুতদারি বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।