প্রবীণ নির্যাতন: লুকিয়ে রাখা ক্ষত

জাতিসংঘ ২০১১ সালে একটি রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে ১৫ জুনকে প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে বিরাজমান প্রবীণ নির্যাতন এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করা। পরিতাপের বিষয় বিশ্বের সব দেশ দিবসটিকে এখন পর্যন্ত যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি; বাংলাদেশও এই শ্রেণিভুক্ত; দেশে দিবসটির এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই; তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এই দিবস এবং এর তাৎপর্য একরকম অজানাই রয়ে গেছে।

প্রবীণ নির্যাতন কোনো দেশের একক সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা; সব দেশে, সব সমাজেই এর উপস্থিতি বিদ্যমান। এর কারণে সারা বিশ্বে অগণিত প্রবীণের শান্তি, সুখ, মর্যাদা, অধিকারসহ সবকিছু বিপর্যস্ত হয়ে চলছে, এমনকি এটি তাঁদের মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠছে কখনো কখনো। তাই এটিকে এখন একটি বৈশ্বিক সামাজিক ইস্যু বলে গণ্য করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার—সংখ্যায় ১৪ কোটিরও বেশি। তবে প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়েও বেশি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সব সমাজেই প্রবীণ নির্যাতনের বিষয়টি আড়াল করার প্রবণতা রয়েছে। এটি নিয়ে রাখঢাক, লুকোচুরি, নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্রই বিরাজমান; এমনকি পরিবারে সর্বাধিক গোপনীয় বিষয়ই হচ্ছে এটি। তাই প্রবীণ নির্যাতন সম্পর্কে প্রকৃত সত্য কোনো সমাজেই জানা যায় না; জানানোও হয় না। এই সত্যকে সামনে রেখে এবারের প্রবীণ নির্যাতন দিবস উপলক্ষে ‘হেল্প এজ ইন্টারন্যাশনাল’ বিশ্বব্যাপী আহ্বান জানিয়েছে ‘প্রবীণ নির্যাতন জানুন এবং প্রকাশ করুন’।

বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রবীণ পিতা–মাতাকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়ে থাকে, যে কারণে প্রবীণ নির্যাতন নিয়ে দেশে তেমন আলোচনা বা উদ্বেগ নেই। তাঁদের সুখ, শান্তি, মর্যাদা, সেবাযত্ন, সব ব্যাপারেই সমাজে একধরনের আত্মতৃপ্তি বিরাজ করে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে হালে সে ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রবীণদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার ঘটনা উঠে আসছে, তাতে ব্যথিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে বিস্মিত হচ্ছেন এবং এক অজানা তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। কয়েক বছর আগে বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে শতকরা ৫ ভাগের মতো প্রবীণ পরিবারে শারীরিক এবং ২০ ভাগেরও বেশি মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন এবং দুঃখজনক সত্য হলো এসব নির্যাতনের প্রায় শতভাগই সন্তান দ্বারা সংঘটিত হয়। বৈশ্বিক চিত্রও তাই।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও মানুষ ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং ভোগবিলাসী হয়ে উঠছে। এ কারণে সন্তানদের একাংশ এখন আর পিতা–মাতাকে পরিবারের অংশ বা পারিবারিক দায়িত্বের অংশ বলে ভাবতে পারে না। সন্তানের নিষ্ঠুরতা এখানেই থেমে নেই; প্রবীণ পিতা–মাতার শারীরিক, মানসিক অক্ষমতাকে জিম্মি করে কেউ কেউ মা–বাবার অর্থসম্পদও করায়ত্ত করে নিচ্ছে; ফলে আর্থিকভাবে সক্ষম প্রবীণেরা চাইলেও কখনো কখনো নিজস্ব সহায়সম্পদের ওপর নির্ভর করে স্বাধীন, মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারছেন না। মোটকথা, দেশে প্রবীণ নির্যাতন তেমন পরিচিত বিষয় না হলেও এর অস্তিত্ব আছে এবং এটি সমাজের কোনো বিশেষ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব শ্রেণিই কমবেশি এই ব্যাধিতে আক্রান্ত।

আশঙ্কার দিক হচ্ছে, দেশে প্রবীণ নির্যাতন ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কারণ আগামী বছরগুলোয় দেশে শুধু প্রবীণের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাবে না, গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে তাঁরা অনেক দিন বেঁচেও থাকবেন; উপরন্তু, অতি-প্রবীণের (৮০ বছরের ঊর্ধ্বে) সংখ্যা প্রবীণের চেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অক্ষম, অসুস্থ, নির্ভরশীল প্রবীণের সংখ্যাও দ্রুত বাড়বে, যা প্রবীণসংক্রান্ত পারিবারিক সমস্যা এবং জটিলতা বাড়িয়ে তুলবে।

এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে প্রবীণ নির্যাতনকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভাবা, এ বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির করা এবং এর প্রতিরোধে/প্রতিকারের বিষয়ে চেষ্টা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা এখন জরুরি। সরকার ও সমাজ সবাই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে এবং আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনে সরকারকে কঠোর নীতি গ্রহণ এবং আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে হবে। এ প্রসঙ্গে ‘পিতা-মাতার ভরনপোষণ’ আইনটির কথা উল্লেখ যায়। আইনটি ২০১৩ সালে পাস হলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো দৃশ্যমান প্রয়োগ দেখা যায়নি, এর জন্য প্রায়ই সন্তানের প্রতি মা–বাবার আবেগকে দায়ী করা হয়; কিন্তু এর একটি বাস্তব দিকও আছে। রাষ্ট্রের তরফে প্রবীণদের জন্য এখন পর্যন্ত বয়স্ক ভাতা ছাড়া তেমন কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা নেই, যার আওতায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশের মতো প্রবীণ মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে থাকেন, যেটি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এ রকম বাস্তবতায় সন্তানের আশ্রয়ে থেকে সন্তানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ বা তাদের সঙ্গে বিরোধে যাওয়া মা–বাবার জন্য কতটা বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিগ্রাহ্য, সেটি ভাবার বিষয়।

প্রবীণদের জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত বা কার্যকর করতে চাইলে তাই তাদের জন্য সন্তানের বাইরে বিকল্প সুরক্ষাব্যবস্থা যেমন, শেল্টার হোম বা আশ্রয়কেন্দ্র, প্রবীণ নিবাস, এ–জাতীয় ব্যবস্থা, যা কমিউনিটিভিত্তিক হলে ভালো হয়, গড়ে তুলতে হবে, যার সুরক্ষা নিয়ে প্রবীণরা প্রয়োজনে তাঁদের প্রতি অন্যায়–অবিচারের আইনি প্রতিকারের চাইতে পারেন। প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি সুরক্ষাই একমাত্র পথ নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় পর্যায়ে প্রবীণদের জন্য ‘প্রবীণ কমিটি’ করা যেতে পারে, যেটি এলাকার প্রবীণদের দৈনন্দিন ভালো-মন্দ দেখভাল করবেন এবং স্থানীয়ভাবে পারিবারিক, সামাজিক সমস্যার সমাধান দেবেন। এনজিওর অভিজ্ঞতা বলে, স্থানীয় পর্যায়ে প্রবীণদের সংগঠিত করেও প্রবীণবিষয়ক অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। সমাজে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চাও বাড়াতে হবে; মানবিক আচরণকে পুরস্কৃত করে উৎসাহিতও করা যেতে পারে। মোটকথা, প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে এবং করোনা মহামারির কারণে বিপর্যস্ত সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটে পদক্ষেপ গ্রহণ এখনই জরুরি।

ড: শরীফা বেগম: সাবেক ঊর্ধ্বতন গবেষণা ফেলো, বিআইডিএস। সহসভাপতি, ফোরাম ফর দ্য রাইটস অব এল্ডারলি, বাংলাদেশ (এফআরইবি)