দক্ষিণাঞ্চলে করোনার অভিঘাত

প্রথম আলোয় সরেজমিন বরিশাল শিরোনামে তিন পর্বে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে পুরোটা না হলেও দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবনের ওপর করোনাসৃষ্ট অভিঘাতের মোটামুটি চিত্র উঠে এসেছে। বরিশাল জেলার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বিভিন্ন এলাকা ঘুরে, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। উপকূলীয় অন্যান্য জেলা, বিশেষ করে ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও বরগুনার পরিস্থিতি আরও নাজুক।

এর আগে বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের জরিপে বলা হয়েছিল, করোনার প্রাদুর্ভাবে উপকূলের ৫৭ শতাংশ পরিবার খাদ্যসংকটে পড়েছে। রোজগার না থাকায় অভাবী মানুষ মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কোনোভাবে চলছেন। কোস্ট ট্রাস্ট যেসব উপকূলীয় জেলা নিয়ে জরিপ করেছে, তার মধ্যে বরিশাল ও ভোলাও আছে।

প্রথম আলোর সরেজমিন প্রতিবেদনে যেসব উদ্বেগজনক তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা হলো মানুষ করোনার চেয়েও জীবিকা নিয়ে বেশি বিচলিত। তঁারা বলেছেন, করোনায় বাঁচলেও অভাবে বাঁচা কঠিন। জীবন চালিয়ে নিতে মধ্যবিত্তরা সঞ্চয়ে হাত দিতে বাধ্য হয়েছেন। তঁারা রোজগার হারালেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা পাননি। করোনা সংকটে সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, ১৩ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং মজুরি বা বেতন কমেছে ২৫ শতাংশের। এর আগে ব্র্যাক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর যে জরিপ করেছিল, তাতে ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় কমার কথা বলা হয়েছিল।

বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক আঘাত এসেছে দুভাবে। প্রথমত করোনার সর্বগ্রাসী থাবা, যাতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু গত মাসে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছিল আম্পান। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরা ও খুলনা। তবে বরিশাল বিভাগের পাঁচটি জেলায় ৪৯ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কঠিন বাস্তবতা হলো করোনার কারণে মানুষের রোজগার কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীও তঁারা কিনতে পারছেন না। ফলে শিশুদের যে পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন, তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাহত হচ্ছে তঁাদের স্বাস্থ্যসেবাও। গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে পড়াশোনা বন্ধ আছে। অন্যদিকে শহরাঞ্চল থেকে কাজ হারিয়ে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দার সংখ্যাও কম নয়। এই জনস্রোত গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে।

এ অবস্থায় সরকারের উচিত দক্ষিণাঞ্চলের অভাবী মানুষের সহায়তায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া। এই মুহূর্তে যাঁদের ঘরে খাবার নেই, তাঁদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকার ব্র্যাক ও ইউনিসেফের মতো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে পারে। হঠাৎ কাজ হারানো মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। মধ্যবিত্তকে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে, যঁারা সহায়তার জন্য কারও কাছে হাত পাততে পারেন না।

আর দীর্ঘ মেয়াদে সরকারকে উপকূলীয় জেলাগুলোতে শিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। উপকূলীয় বাঁধের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আশা করি, সরকারের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলো অগ্রাধিকার পাবে। উন্নয়ন মানে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কাউকে পেছনে ফেলে যাওয়া নয়।