করোনার পরের পৃথিবী মোকাবিলায় তরুণেরা আমাদের মতো না হোক

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো
প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

করোনা বাংলাদেশে জেঁকে বসেছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু সাধারণ মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীদের গণ্ডি পেরিয়ে বড় ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচারক, সংসদ সদস্য, এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ফকির থেকে বাদশা পর্যন্ত কেউ করোনার সংক্রমণ থেকে রেহাই পাবে না। আর এ জন্য আমাদের মতো প্রবীণেরাই দায়ী।

করোনার ঝড় হয়তো একসময় থেমে যাবে। ঝড় যেমন বড় গাছ উপড়ে ফেলে, করোনা তেমনই বড়দের অর্থাৎ প্রবীণদের নিয়ে যাচ্ছে। আমি পঞ্চাশের কোঠায় পা দেওয়া একজন প্রবীণ। করোনা ঝড়ে আমিও যেকোনো সময় উপড়ে যেতে পারি। তবে তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কেননা আমাদের খামখেয়ালিপনা, নির্বুদ্ধিতা, হীন মানসিকতা, অদূরদর্শিতা ও মূর্খতার পরিণতি তো আমাদেরই ভোগ করতে হবে। আমরা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক না করে মূর্খের মতো বিদেশি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়েছি। আমরা স্বাস্থ্য খাতকে অবহেলা করে এর কাঠামোগত পরিবর্তন করিনি। এ খাতের ব্যবস্থাপনার দক্ষ কাঠামোও তৈরি করিনি। সরকারি স্বাস্থ্য খাতকে যেনতেনভাবে চালু রেখেছি। আর বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনার লাগাম টেনে ধরতে পারিনি। সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা অদক্ষ ও অপেশাদার কর্মকর্তা এবং মাফিয়া চক্রের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বলা চলে স্বাস্থ্য খাতের কোনো অভিভাবক নেই।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আমরা জাতিগতভাবে এক হতে পারিনি। স্বাধীনতার স্বপক্ষ এবং বিপক্ষ বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি, যা আমাদের চিরস্থায়ী বিভাজনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা সামরিক-বেসামরিক, ক্যাডার-নন ক্যাডার এবং প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে এই বিভাজনের বহুমাত্রিক দিক উন্মোচন করেছি। আমরা আমৃত্যু দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।

আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে গলা টিপে হত্যা করেছি। বৃত্তিমূলক এবং গুণগত মানের শিক্ষার বদলে মানহীন সাধারণ শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে আমরা লাখ লাখ অর্ধশিক্ষিত বেকার তৈরি করেছি। আমরা কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করেছি। আমরা পেশাজীবীদের মূল্য বুঝিনি। পেশাজীবী তৈরি হওয়ার পরিবেশও সৃষ্টি করিনি। সর্বদা লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলা এবং তাদের তোষণে মনোযোগী হয়েছি। আমরা সর্বদা সংকীর্ণতা, লোক ঠকানো এবং লোক দেখানো কাজে ব্যস্ত থেকেছি।

আমরা নদী ও বনসহ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেশকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছি। খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরি না করে উঁচু উঁচু বিল্ডিং তৈরি করেছি। উত্তরাধিকার সূত্রে দু-চারটা যা পেয়েছিলাম সেখানে বাজার বসিয়েছি। ফুটপাতেও বাজার বসিয়েছি। রাস্তা ও ফুটপাতকে পাবলিক টয়লেট বানিয়েছি। যুগোপযোগী পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হয়েছি।

পলিথিনসামগ্রী তৈরি আইনত বন্ধ থাকার পরও আমরা তার ব্যাপক ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে শান্তি, মানবিকতা এবং কর্মসংস্থানের পরিবর্তে কেবল প্রবৃদ্ধিকে বিবেচনা করেছি। তোমাদের ভালো মানুষ হওয়ার দীক্ষা না দিয়ে স্বার্থান্বেষী এবং হীন মানসিকতার শিক্ষা দিচ্ছি। সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের পরিবর্তে লুটতরাজ করেছি।

আমরা গণতন্ত্রের পরিবর্তে নিপীড়ন এবং নির্যাতনের সংস্কৃতি চালু করেছি। নির্বাচন ব্যবস্থাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করেছি। ঘরে ঘরে রাজনীতি ঢুকিয়ে ভাই ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে হাজার বছরের সামাজিক পুঁজি নষ্ট করেছি। করোনা সম্পর্কে সতর্কতামূলক বার্তা ঠিকমতো প্রদান না করে সামাজিক পুঁজির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকিয়েছি। আমরা নির্যাতিতার আকুতি শুনিনি। আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারিনি। অর্থ ও পেশি শক্তিকে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি বানিয়েছি। করোনা হয়তো তাই আমাদের মতো বহুরূপী প্রবীণদের বিনাশের জন্য পণ করে এসেছে।

আর স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিপড়ুয়া নবীনেরা এসব কিছু উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে যাচ্ছে। আমার ‍দুঃখ এখানেই। করোনা–উত্তর পৃথিবী কত কঠিন হবে তার কিছু লক্ষণ তো বোঝাই যাচ্ছে। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানি তো আছেই। তাই নবীনদের উদ্দেশে কিছু বলার প্রয়োজন অনুভব করলাম।

নবীনদের প্রতি আহ্বান, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই সব মন্দ জিনিস যেন তারা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে। ভালো যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা যেন তারা গ্রহণ করে। নবীনদের একদিকে যেমন বিনয়ী হতে হবে, অন্যদিকে সাহসী ও প্রতিবাদী হতে হবে। তবে আইন ভঙ্গ বা বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি কোনোভাবেই নয়। নবীদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখে। ধর্মীয় কিংবা সামাজিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা তাদের কাছে কাম্য নয়। জাতীয় নেতাদের উপযুক্ত সম্মান করা নবীনদের দায়িত্ব। ব্যক্তিগত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে শর্টকাট পন্থা অবলম্বন নয়। ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা অন্বেষণ করে তার যথাযথ অনুশীলন নবীনদের কাছে প্রত্যাশিত। চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ যেন কখনো প্রশ্রয় না পায়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করাই যেন হয় তরুণদের লক্ষ্য। আশা করি এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তরুণেরা ফিরিয়ে আনবে যাতে মেধাবীরা রাজনীতিতে আসে।

আমার প্রত্যাশা তরুণেরা শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করবে। বর্তমানে প্রচলিত জিপিএ এবং পরীক্ষামুখী শিক্ষার বদলে মানবতা এবং কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করবে। যে শিক্ষাব্যবস্থা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী এবং দেশবাসীর মধ্যে অটুট বন্ধন স্থাপন করবে। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি শক্তিশালী করে এর গণ্ডি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করবে, জমিজমার হিসাবসহ সাধারণ গণিত, পরিবেশ এবং সমাজ কাঠামো, ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সাধারণ আইন কানুনসহ জীবন চালানোর মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করবে। অষ্টম শ্রেণির পরে শিক্ষার্থীদের তাদের আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করে এবং এর সঙ্গে জীবিকার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নিকট আকর্ষণীয় করে তুলবে। অন্যদিকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ পদ্ধতি উঠিয়ে দিয়ে সাধারণ পাস-ফেল পদ্ধতি চালু করবে যাতে শিক্ষার্থীরা কোচিং এবং গাইডমুখী না হয়ে শিক্ষামুখী হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচলন করবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবলেম বেইসড লার্নিং পদ্ধতি চালু করবে এবং গবেষণার ওপর জোর দেবে।

আমার চাওয়া স্বাস্থ্য খাতেও তরুণেরা আমূল পরিবর্তন আনবে। ভবিষ্যতে যে নবীনের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বড় ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি কিংবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবে, সবাই দেশীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে চিকিৎসা নেবে। আর তাহলেই বুঝতে পারবে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের গলদ কোথায়। স্কুল ও কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রচলন ঘটিয়ে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যের শক্ত ভিত্তি রচনার কাজটি তরুণেরাই করবে। সরকারি স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর পরিবর্তন ঘটিয়ে এটিকে কার্যকরী করবে। আর বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে নিজস্ব জনবল দিয়ে পরিচালনা নিশ্চিত করবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে অন্তত প্যারামেডিক নিয়োগ করে সেবার মান বৃদ্ধি করবে। শহর এলাকায় প্রতি ৪ থেকে ৫ হাজার পরিবারের জন্য একটি করে আরবান ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। তোমরা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিমার প্রচলন করবে। আর এসব পরিবর্তন সাধনের জন্য একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করবে।

এসব পরিবর্তনের দায়িত্ব তো মূলত প্রবীণদেরই। কিন্তু আমরা প্রবীণেরা ব্যর্থ। প্রবীণ হিসেবে তাই আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। করোনা–উত্তর পৃথিবীতে বাঁচতে হলে নবীন-তরুণদের এসব পরিবর্তন করতেই হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস নবীনেরা তা পারবে।

*ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।