অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। এখন গড়ে দৈনিক চার হাজারের কাছাকাছি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ২৯ জুন পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৮০১ এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৭৮৩ জন। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি বেগবান হয়েছে ৩০ মে সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকে। এর পরের এক সপ্তাহের মাথায় সংক্রমণপ্রবণতায় উল্লম্ফন শুরু হয়। শেষ ২০ দিনে মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে আগের তিন মাসের মোট রোগীর দ্বিগুণ হয়েছে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে করোনা মহামারি বাড়তি উদ্বেগজনক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। বিশেষজ্ঞরা অন্তত সপ্তাহ দুয়েক আগেই এমন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছিলেন যে বিশেষত শহরাঞ্চলে সংক্রমণ বিস্ফোরক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে। বাস্তবে আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, দেশের যে ২৭টি জেলায় সংক্রমণের মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম ছিল, জুন মাসে, অর্থাৎ ছুটি শেষ হওয়ার পরের প্রায় এক মাসে সেসব জেলায় সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে দেশের সব এলাকায় সংক্রমণের গতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী।

এ অবস্থায় করণীয় কী? কী উপায়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির এ দ্রুতগতিতে রাশ টানা যেতে পারে? বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করা সংক্রমণ রোধের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। কিন্তু সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকে এ ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং তার পরিণতিতে রোগীর সংখ্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। আবার যেহেতু অনির্দিষ্টকাল ধরে সারা দেশ লকডাউন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু বিশেষজ্ঞরা বলছেন সর্বাধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোতে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। এলাকাভিত্তিক লকডাউন বা স্বাস্থ্যবেষ্টনী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি যে রোধ করা সম্ভব, তা পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সে কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সর্বাধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোকে লাল এলাকা বা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারপর বলা হয়েছে, লাল এলাকাগুলোতে ‘আংশিক লকডাউন’ বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু একটি রেড জোনের ভেতরেই কোনো কোনো অংশে লকডাউন এবং বাকি অংশগুলোতে লকডাউন নয়—এ রকম ঘোষণায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে এবং বস্তুত কোনো রেড জোনেই প্রকৃত অর্থে যথার্থ লকডাউন বাস্তবায়ন হয়নি।

রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৫০টি এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু সেই অর্থে লকডাউন বাস্তবায়নের খবর পাওয়া গেছে শুধু পূর্ব রাজাবাজারে। এর পরে বলা হচ্ছে পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকায় লকডাউন কার্যকর করার কথা। কিন্তু অন্য রেড জোনগুলোতে কেন লকডাউন নেই? আর কোনো রেড জোনে যদি লকডাউন না থাকে, তাহলে কী বৈশিষ্ট্য দ্বারা বোঝা যাবে যে সেটা একটা রেড জোন?

রেড জোনগুলো চিহ্নিত করার পর এলাকাভিত্তিক লকডাউন বাস্তবায়নের খুঁটিনাটি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে কেন এত সময় লাগছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। কিন্তু আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। অবিলম্বে রেড জোনগুলোতে এলাকাভিত্তিক লকডাউন বা স্বাস্থ্যবেষ্টনী কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এলাকাবাসীর অতি জরুরি সেবাব্যবস্থাগুলো কীভাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে তাদের লিখিত নির্দেশনা থাকতে হবে এবং সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে এলাকাভিত্তিক লকডাউন বলতে এলাকাবাসীকে কী বুঝতে হবে; তাঁরা কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না ইত্যাদি বিষয়ে অবশ্যপালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও বিতরণ করতে হবে। সর্বোপরি এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঠিকমতো কার্যকর করা হচ্ছে কি না, সেদিকে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে।