পথশিশু ও মানব পাচারকারীর পার্থক্য

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

যঁার যথেষ্ট টাকা আছে, তাঁকে ব্যাংকে টাকা রাখতেই হয়। ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালে যে শীর্ণ পথশিশু ফুল বিক্রি করে, তারও ব্যাংকে টাকা সঞ্চয়ের ইচ্ছা হয়। ওরা দশ টাকার একটা বেলি ফুলের মালা মোটরগাড়ির সাহেব বা মেমসাহেবকে গছাতে যারপরনাই পীড়াপীড়ি করে। সারা দিন ফুল বেচে যা লাভ হয়, তা থেকে দশটি টাকা কোনো দিন জমায়। মাসখানেক পর শ তিনেক টাকা জমলে কেউ তা ব্যাংকে রাখে।

গত জানুয়ারিতে এ রকম একটি খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৭ হাজার ৬৪৭টি পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুর হিসাব খোলার তথ্য পাওয়া যায়। তাদের হিসাবে জমানো অর্থের স্থিতির পরিমাণ সাড়ে ৩৮ লাখ টাকা। পথশিশুরা শিক্ষার আলো পায়নি। ব্যাংকের ফরম পূরণ করা দূরের কথা, নাম দস্তখতটা পর্যন্ত করতে পারে না। পথশিশুদের পক্ষে ১৫টি এনজিও তাদের হিসাব পরিচালনা করে। এখন মোট ১৯টি ব্যাংক পথশিশুদের হিসাব পরিচালনা করছে। ঋণখেলাপিরা ব্যাংক থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ফেরত দেননি, তার মধ্যে পথশিশুদের ৩৮ লাখ টাকার কিছু অংশও আছে।

বাংলাদেশের যেসব লোক ইয়াবার ব্যবসা করে বা মানব পাচার করে মুনাফার অর্থে ঘর ভরে ফেলেছেন, কিংবা যেসব কর্মকর্তা ‘উপার্জন’ করেছেন বস্তা বস্তা টাকা, তাঁরাও নামে-বেনামে ব্যাংকে সঞ্চয় করেন। দেশের ব্যাংকে সব টাকা রাখা সম্ভব না হলে ভিনদেশি ব্যাংকের শরণাপন্ন হন। যেমন সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে আমাদের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। বাংলাদেশি হিসেবে এ আমাদের অহংকার করার মতো ঘটনা।

বিশ্ববাসী জানল বাংলাদেশিরা সত্যি বড়লোক। প্রায় সব ব্যাপারে আমরা তলানিতে থাকলেও টাকাপয়সা পাচারের ক্ষেত্রে আমাদের রোল নম্বর একেবারে ওপরে। ২৫ জুন প্রকাশিত সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত প্রথম। বাংলাদেশের পরে রয়েছে পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।

সুইজারল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশের ব্যাংকে কেউ টাকা রাখলেই সে টাকা অবৈধ তা হয়তো নয়। কিন্তু বৈধর সঙ্গে অবৈধ টাকাও আছে কি না এবং সে টাকা কার এবং সেখানে কী প্রক্রিয়ায় গেল, সে তথ্য জোগাড় করা খুব বেশি কঠিন নয়। সেই কাজটি আমাদের রাষ্ট্র করেছে কি না, সাধারণ মানুষের সেটাই জিজ্ঞাসা।

বিদেশে টাকা পাচার করা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির একটি উপসর্গ মাত্র, রোগ নয়। যাঁরা বিদেশি ব্যাংকে টাকা যাঁরা সঞ্চয় করেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ধনী লোক। ধনী লোককে মানুষ সমীহ করে। সুইস ব্যাংকে টাকা আছে, সে কথা তাঁরা বুক ফুলিয়ে বললে আমাদেরও ভালো লাগে। কিন্তু তাঁরা যেহেতু তা চক্ষুলজ্জাবশত বলবেন না, সুতরাং রাষ্ট্রের কতর্ব্য তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া এবং সেই সৌভাগ্যবানদের জীবনবৃত্তান্ত দেশবাসীকে অবগত করানো। কেউ নিজের টাকা ব্যাংকে রাখবেন, না বাঁশের খোলের ভেতরে রাখবেন, না তোশকের ভেতরে রাখবেন, তা তাঁর ব্যাপার। অন্য কারও তা নিয়ে মাথা ঘামানো অসমীচীন। কিন্তু টাকা কী উপায়ে অর্জিত হলো, তা জানতে চাওয়া দোষের নয়।

টাকা পাচার রোগ নয়, রোগ হলো নষ্ট রাজনীতিপ্রসূত দুর্নীতি। অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয় নষ্ট রাজনীতি। নষ্ট রাজনীতি রাষ্ট্রের কর্মচারীদেরও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত করে।

রাষ্ট্রের কর্মচারীদের সহযোগিতা না পেলে অর্থপাচারী বা আদম পাচারীরা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। একা পাচারীর পক্ষে ভিসা–বাণিজ্য করা সম্ভব নয়, দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। প্লেনভর্তি আদমসন্তান পাচার হলো, প্রজাতন্ত্রের কেউ জানে না, তা বিশ্বাস্য নয়। ব্যাংকের খারাপ ঋণের জন্য ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না।

আইনকানুন মেনে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা অসম্মানজনক নয়। কিন্তু অবৈধ মানব পাচার অতি অমর্যাদাকর ফৌজদারি অপরাধ। আলোচ্য মানব পাচারকারী ‘কুয়েতি মারাফিয়া’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাঁর পত্নীর ভাষায় ‘গর্বিত রেমিট্যান্সযোদ্ধা’। একাত্তরের পর থেকে ‘যোদ্ধা’ শব্দটি সব রকম বিশেষ্য পদের পরেই যোগ হচ্ছে। হেঁশেলের বাবুর্চিকেও ‘রান্নাযোদ্ধা’ বললে ঠেকায় কে?

ব্যবসা-বাণিজ্য আর প্রতারণা দুই জিনিস। যে কাজ দেওয়ার শর্তে একজন যুবক বা যুবতীকে বিদেশে নিয়ে গেছেন, বিদেশে সেই কাজ ও মজুরির শর্ত ভঙ্গ করা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা গেল, ভিটেমাটি বিক্রি করে একজন টেকনিশিয়ানের চাকরি পাবেন, এই শর্তে গিয়েছিলেন কুয়েতে। গিয়ে পেলেন সুইপারের কাজ। যে বেতনের প্রতিশ্রুতি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, দেওয়া হলো তার তিন ভাগের এক ভাগ। প্রতিবাদ করায় তাঁকে বলা হলো, ‘বেশি কতা কইলে মাইরা প্যাকেট কইরা মরুভূমিতে ফেলাইয়া দিমু’। অনেককে নিয়ে গিয়ে খাবারের টাকাটাও দেয় না কুয়েতি মারাফিয়া। টাকা চাইলে বলা হয় ‘টাকাপয়সা না থাকলে মরুভূমির বালু খাও।’

আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিদিনই হুংকার দেয় ‘কাউকে ছাড়’ দেওয়া হবে না। তাদের কর্মকর্তারা ছুটছেন ৪০ বস্তা ত্রাণের চাল আত্মসাৎকারী ইউপি মেম্বারের বাড়িতে বা দোকানে। মানব পাচারীদের তঁারা পাকড়াও করেছেন, এমন খবর পাওয়া যায় না। শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একার কাজ নয়, এই শ্রেণিকে নজরদারির মধ্যে রাখা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেরও কর্তব্য। প্রতিটি সংশ্লিষ্ট সংস্থার বারো আনা কাজ তো মিডিয়াই করে দিচ্ছে।

যে টাকা পাচার হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ ফতুর হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ভেঙে পড়বে না। কিন্তু অন্যখানে ক্ষতি সীমাহীন। শুধু অর্থনীতি দিয়ে সবকিছু বিচার্য নয়। একজন সৎ ব্যবসায়ী দুবাই, জেনেভা, ফ্রাঙ্কফুর্টে গিয়ে তিন তারা হোটেলে থাকেন। আর একজন অর্থ ও আদম পাচারী থাকেন বিলাসবহুল পাঁচ তারা হোটেলের স্যুইটে। অবৈধ ও অনৈতিক উপায়ে অর্জিত অর্থবিত্তশালী নষ্ট মানুষদের চাপে ভালোরা প্রান্তে সরে যাবে। উন্নত সমাজ গঠনের পথে তা বাধা।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় একজন পথশিশুর সঙ্গে একজন মানব পাচারকারীর পার্থক্য হলো প্রথমজন সড়কে ফুল বেচে তার সাধ্যমতো ব্যাংকে জমায়, দ্বিতীয়জন ব্যবসার নাম করে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে তা পাচার করে। মুখে যতই ‘জিরো টলারেন্স’–এর কথা বলা হোক, আমাদের রাষ্ট্র পরম সহিষ্ণু। কিন্তু কঠোর না হলে একটি সুস্থ মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক