পাটকলের থলের বিড়াল বের করবে কে?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল বন্ধ করে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক বা স্বেচ্ছায় অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় পাটকল আছে ২৬টি। এর মধ্যে একটি (মনোয়ার জুট মিল) বন্ধ রয়েছে। বাকিগুলো কোনো রকমে চলছে। পাটকলগুলোয় বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক ২৪ হাজার ৮৬৬ জন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার।

পাটকলের শ্রমিকেরা এই সিদ্ধান্ত মানবেন না জানিয়েছেন। তাঁরা প্রতিদিন মিলগেটে দুই ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। সরকার সিদ্ধান্ত না বদলালে ১ জুলাই থেকে তাঁরা আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিকনেতা খলিলুর রহমান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের লোকসানের জন্য শ্রমিকেরা দায়ী নন। তাঁরা দুর্নীতি করেন না। ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণেই কারখানাগুলো লোকসান দিচ্ছে। তাঁর মতে, যে টাকা দিয়ে সরকার শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিতে চাইছে, সেই টাকা কারখানার সংস্কারে ব্যয় করলে লাভবান করা সম্ভব।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। এর মধ্যে পাটকলগুলোর উৎপাদিত মূল পণ্য পাটসুতা ৩৩ শতাংশ এবং চট ও বস্তা রপ্তানি ৬ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানির ৮০ শতাংশই বেসরকারি পাটকলের দখলে। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) কর্মকর্তারা বলবেন কি, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো লাভ করতে পারলে সরকারি পাটকল কেন লোকসান গুনল?

স্বাধীনতার পর যে উদ্দেশ্য নিয়ে পাটকলগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছিল, তা পূরণ না হওয়ার পেছনে পূর্বাপর সরকারগুলোর অদক্ষতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা দায়ী। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষের বা বিপক্ষের, গণতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে কোনো মৌলিক ফারাক নেই। সব আমলেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লোকসান দিয়েছে। কেন দিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। একজন সাবেক মন্ত্রী রেলের কালো বিড়াল খুঁজতে গিয়ে নিজেই তার শিকার হয়েছিলেন। পাটকলের থলের বিড়াল বের করবেন কে?

স্বাধীনতার সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ছিল ৭৮টি। এখন সেটি ২৬টিতে নেমে এসেছে। তবে বেসরকারি খাতে পাটকল কয়েক গুণ বেড়েছে। কেন এমনটি হলো? পাটকলগুলো লাভজনকভাবে চলুক, তা কি নীতিনির্ধারকেরা চেয়েছেন? চাইলে পারেননি কেন?

লোকসানের জন্য এখন শ্রমিকদের দায়ী করা হচ্ছে। তাঁদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকেরা তো কারখানা পরিচালনা করেন না। পাটকল পরিচালনা করেন, বিজেএমসির কর্তাব্যক্তিরা। বিজিএমসির কর্তাব্যক্তিদের পরিচালনা করেন মন্ত্রী-সচিব। তাহলে পাটকলগুলি যদি হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনে থাকে, তার দায় কেবল শ্রমিকেরা কেন নেবেন? কেন মন্ত্রী-সচিব-চেয়ারম্যানরা নেবেন না? কেন শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার আগে কারখানার ব্যবস্থাপক তথা বিজেএমসির পদাধিকারীদের গোল্ডের হ্যান্ডশেক দেওয়া হবে না?

এক হিসাবে দেখা গেল, গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সাত হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি কত আর শ্রমিকদের যাঁরা পরিচালনা করেন, বিজিএমসির কর্তাব্যক্তিদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি, বিদেশভ্রমণ ইত্যাদিতে কত টাকা ব্যয় করেছেন, সেই হিসাবটা নেওয়া প্রয়োজন। পাট সরবরাহকারী আড়তদারদের ভূমিকাটাও সামনে আনা প্রয়োজন।

গত রোববার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, ‘আমরা লোকসান নিয়ে পাটকল চালাতে পারি না। সরকার চিন্তা করেছে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে এই খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, পাটকল শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে।

যে সরকার ১১ বছরেও পাটকলগুলো ভালোভাবে চালাতে পারেনি, তারা পিপিপির মাধ্যমে চালাতে পারবে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা বহু বছর ধরেই পিপিপির গল্প শুনে এসেছি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাফল্য মেলেনি। পিপিপির নামে স্বার্থান্বেষী মহল রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর যে বিশাল সম্পত্তি আছে, তা আত্মসাৎ করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পাট খাতকে লাভজনক করার অঙ্গীকার করেছিল। ক্ষমতায় আসার পর বিজেএমসিকে লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনাও নেয় তারা। সরকার বিজেএমসির দেনা পরিশোধ করতে ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয়। এই অর্থ দিলে ভবিষ্যতে বিজেএমসির জন্য আর কোনো আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হবে না—এ শর্তে পাট মন্ত্রণালয়, বিজেএমসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। এরপর বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া খুলনার খালিশপুর জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী জুট মিলস ও ফোরাম কার্পেটস ফ্যাক্টরি ফিরিয়ে নিয়ে চালু করে সরকার।

বিজিএমসির একজন সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল আলাপ হলো রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের হালচাল নিয়ে। তিনি বললেন, স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় সরকারি পাটকলগুলো লোকসান দিয়েছে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে। ১৯৮২ সালে এরশাদ গায়ের জোরে ক্ষমতায় আসার পর পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন সাবেক আমলা এস এম শফিউল আজমকে। তিনি বিরাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যাঁদের হাতে মিলগুলো দেওয়া হয়, তাঁরা সেগুলো চালাননি। অনেকে কারখানা বিক্রি করে বিদেশে চলে গেছেন। জিয়াউর রহমানের আমলেও কিছু কারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পাটজাত পণ্যের চাহিদাও কমে যায়। এরশাদের আমলে পাটকলে লোকসানের আরেকটি কারণ হলো শ্রমিকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার। সরকার ও আন্দোলনরত বিরোধী দল—উভয়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের ব্যবহার করেছিল।

তবে শ্রমিকদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার কেবল এরশাদ আমলেই হয়নি; সব আমলেই হয়েছে। রোববার সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে একজন সাবেক বামপন্থী কর্মী লিখেছেন, স্বাধীনতার পর যেসব কারখানার সিবিএ (কেন্দ্রীয় বার্গেনিং এজেন্ট) সরকার সমর্থক শ্রমিক লীগের ছিল, সেব কারখানায় লোকসান হতো। আর যেসব কারখানায় বিরোধী দলের সিবিএ ছিল, সেসব কারখানা লাভ করেছে। পরে সরকার–সমর্থকেরা সব কারখানা দখল করে নেন। এ বিষয়ে একজন সাবেক শ্রমিকনেতার সঙ্গে আলাপ করলে তিনি এর সত্যতা স্বীকার করেন। একই সঙ্গে এও বলেন, এই দখলদারি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—সব আমলেই হয়েছে। সরকারি শ্রমিক সংগঠনগুলো দল ভারী করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দিতে ব্যবস্থাপকদের বাধ্য করত। ভুয়া শ্রমিক দেখিয়ে তারা মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিত সরকারি কোষাগার থেকে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে বিজেএমসির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন।

২০১৪-১৮ মেয়াদে পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মির্জা আজম। ২০১৭ সালে জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, বিজেএমসি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতি এমনভাবে গ্রাস করেছে প্রতিষ্ঠানটিকে যে দুর্নীতিই সেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাঁর দাবি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় লোকসান কমেছে। (ঢাকা টাইমস, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ২৭ বছর পর ২০১০-১১ অর্থবছরে বিজেএমসি ১৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা লাভ করেছিল। আর গত ১০ বছরে লোকসান দিয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগে জিয়াউর রহমানের আমলে টানা তিন বছর লাভ করেছিল সংস্থাটি। তাহলে অন্যান্য বছর কেন হাজার কোটি টাকা লোকসান দিল?

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের ধারাবাহিক লোকসানের অন্যতম কারণ পাট ক্রয় ও পরিবহন খাতে দুর্নীতি ও অনিয়ম, অলস মজুরি প্রদান, সক্ষমতা অনুসারে মিলের কার্যক্রম পরিচালনা না করা এবং অলস পাট ক্রয়কেন্দ্র পরিচালনা। এ ছাড়া কাঁচা পাট ক্রয়ে অদক্ষতা, উৎপাদনে সিস্টেম লস, বেশি খরচে পুরোনো মেশিন পরিচালনা, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, পরিচালনা ব্যয় ও বিপণন অদক্ষতার কারণে লোকসান হচ্ছে।

যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিজেএমসিকে মহাদুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন, তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তিনি দাবি করেছিলেন, দুর্নীতি কমেছে। পরিসংখ্যান বলে, দুর্নীতি ও লোকসান কোনোটাই কমেনি। দুর্নীতির কারণে কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেবল শ্রমিকেরা কেন কাফফারা দেবেন? শ্রমিকদের যাঁরা পরিচালনা করছেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।