করোনায় মৃতের সৎকারে যা জানাতে হবে

জ্বর ও শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়া কলেজশিক্ষকের কবর খোঁড়া হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, ১২ জুন। ছবি: সংগৃহীত
জ্বর ও শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়া কলেজশিক্ষকের কবর খোঁড়া হচ্ছে। রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম, ১২ জুন। ছবি: সংগৃহীত

করোনায় মৃত্যু যেন অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল মানুষকে। পত্রিকার পাতায় নিত্য দেখি, অসুস্থ রোগীকে চরম অবহেলা, পরিবার ভয়ে ফেলে রেখে চলে যায়, রোগীর পরিচয় দিতে চায় না। এ কারণে রোগীকে রোগাতঙ্ক গ্রাস করে, তারা রোগ লুকিয়ে রাখে। এ ছাড়া নানা অবহেলা, নিপীড়নের অসহনীয় সত্য কাহিনি নিউজফিডে থাকে প্রতিদিন।

এত দিন এটাই আমাদের জানা ছিল, যে যত বড় শত্রু হোক না কেন, মৃতদেহের সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই। সব ধর্মের মানুষ তাঁর মৃত্যুর পরে সেই রীতি অনুযায়ী পরিপূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে দাফন ও সৎকার পাবে। কিন্তু করোনার ব্যাপারটা যেন পুরোই আলাদা। এ রোগে শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা কোনো অংশে কম নয়। কারণ, শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি নন, তাঁর পরিবারের লোকজন সমান রকম যন্ত্রণা ভোগ করেন। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে মারা যান ওই ব্যক্তি, তবে তাঁর দাফন ও সৎকার নিয়ে দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই বাকিদের।

পত্রিকা মারফত জেনেছি, পরিবারের পক্ষ থেকে বহু কষ্টে লাশ তাঁর নিজ এলাকায় নেওয়ার পরও কবরের জায়গা হয়নি, স্থানীয় লোকজন বাধা দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, নানা নিগ্রহ-নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারকে। এ রকম নয় যে এটা শুধু নিম্নবিত্ত-অশিক্ষিত লোকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেক শিক্ষিত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও অনেক জায়গাতেই লাশ দাফন করতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কাজ সমাধা হয়েছে।

বাংলাদেশে আমাদের নানা সমস্যা আছে। নেই পর্যাপ্ত সুবিধাসংবলিত চিকিৎসাসেবা, অভাব আছে সঠিক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা, রয়েছে সময়োপযোগী চিন্তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুরূহ জটিলতা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, পত্রপত্রিকায় দাফনে জটিলতাসংক্রান্ত অনেক খবর দেখতে পেলেও মৃত ব্যক্তি রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়ে সচেতনতামূলক লেখা কম। অনেকেই আসলে বিষয়টি জানেও না, স্রেফ আশঙ্কা থেকে আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে। গত ২৯ এপ্রিল বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে, প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের মুখপাত্র উইলিয়াম আডু ক্রো বলেন, ‘মৃতদেহ থেকে জীবিত মানুষের দেহে এ সংক্রমণ ছড়ানোর কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’

কয়েক দিন আগে প্রথম আলো পত্রিকা মারফতই জেনেছি, মৃত্যুর তিন থেকে চার ঘণ্টা পরে মৃতদেহ থেকে রোগ সংক্রমণ হয় না। কিন্তু এটি কতখানি মানুষের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া আইইডিসিআরের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, নিয়ম মেনে দাফন-সৎকার থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে না। যদি তা–ই হয়, তবে গণমাধ্যমগুলোয় এ বিষয়ে প্রচারণা অনেক বেশি নয় কেন? ১৮ জুন প্রকাশিত প্রথম আলোর সংবাদ থেকে দেখা গেছে, ‘জানাজা দাফনে বাধা আসা সেই নারীর করোনা নেগেটিভ’। তার মানে, শুধু সন্দেহের বশে ওই বিধবা নারীর দাফনে বাধা দেয় কতিপয় গ্রামবাসী। এহেন সন্দেহ, শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ঐক্য বিনষ্টকারী।

হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে অনীহা দেখালে এবং এতে ওই রোগীর মৃত্যু হলে ‘তা অবহেলাজনিত মৃত্যু’ অর্থাৎ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। লাশ দাফনে বা সৎকারে বাধা দিলেও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। সরকারিভাবে যদিও কিছু জায়গা দাফনের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, তবু বাধা থাকে। যদি তিন থেকে চার ঘণ্টা পর থেকে লাশ থেকে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে মানুষকে তা জানাতে হবে জোরেশোরে। অনেক বেশি প্রচার হওয়া উচিত এ তথ্যের। যেমনটা হাত ধোয়া বা মাস্ক পরার ব্যাপারে বারবার বলা হচ্ছে।

তাই মানুষের উপকারার্থে এ ব্যাপারেও সচেতনতামূলক লেখা প্রকাশ জরুরি, যা থেকে বহু মানুষ সত্যিকারের তথ্য জানতে পারবে। রোগ থেকে বাঁচার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নাই সত্যি। তবু এত কিছুর পরেও মহামারিতে রোগ কার হবে, কার হবে না, এটা কেউ বলতে পারে না। কেউ নিশ্চয় নিজের ইচ্ছায় করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেও না। প্রিয়জন হারানো খুবই বেদনার, ওই সময়ে মানসিক সমর্থন না পাওয়া এবং অবহেলা-নিগ্রহের ভয় মানুষকে আরও ব্যথিত, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে। অবশ্যই পর্যাপ্ত সতর্কতা ও বিধিমোতাবেক মৃত করোনা রোগীর সৎকারের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। সরকারিভাবে করোনা প্রতিরোধমূলক বিষয় প্রচারের পাশাপাশি মৃত রোগীর রোগ সংক্রমণসংক্রান্ত বিষয় নিয়েও যথেষ্ট প্রচারণা দরকার। দরকার সামাজিক নিগ্রহ ও আতঙ্কের ট্যাবু ভাঙা। গণমাধ্যমই পারে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে।

*তামান্না শারমিন: ফ্রিল্যান্সার লোকাল ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট, নটিংহ্যাম, ইংল্যান্ড।