বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দুর্ঘটনা

পথেঘাটে একের পর এক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে মানুষের জীবনের চেয়ে তুচ্ছ আর কিছু নেই। সড়ক, নৌ—সব পথই যাত্রীদের জন্য হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। করোনাভাইরাসের কারণে যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা কম। এরপরও ২৫ মার্চ থেকে ২৫ মে দুই মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩২৫ জন। গত সোমবার বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবে ৩৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নৌযাত্রাও নিরাপদ নয়।

সাধারণত ঝড় বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে কিংবা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এ কারণে ঝড়–বৃষ্টির দিনে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বুড়িগঙ্গায় কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। মুন্সিগঞ্জ থেকে সকাল সোয়া আটটায় রওনা দিয়ে এমভি মর্নিং বার্ড নামের একটি ছোট লঞ্চ সদরঘাটের কাছাকাছি শ্যামপুরে এসে পৌঁছায় সোয়া নয়টার দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এ সময় চাঁদপুরগামী এমভি ময়ূর-২ পেছনের দিকে বাঁক নিতে গিয়ে ছোট লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়ে কার্যত এর ওপর দিয়ে চলে যায়। ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে ৫০–৬০ জন যাত্রী ছিলেন। ডুবুরিরা ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন।

ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না, সেখানে আরও লাশ আছে কি না। লঞ্চ উদ্ধারেও বিপত্তি ঘটেছে। উদ্ধারকারী লঞ্চটি মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত দুর্ঘটনাস্থলে আসতে পারছে না পোস্তগোলায় অবস্থিত বুড়িগঙ্গা সেতুর কারণে। উদ্ধারকারী লঞ্চটির ধাক্কায় সেতুও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) তিন সদস্যের ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ময়ূর-২–এর মালিকের বিরুদ্ধে মামলা এবং তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও লঞ্চের চালক পলাতক রয়েছেন। 

এখন তদন্ত কমিটির দায়িত্ব দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা এবং সরকারের দায়িত্ব দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে মনে হয়, এটি হত্যাকাণ্ড। তদন্তের আগেই মন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে এ ধরনের মন্তব্য করা দায়িত্বশীলতার পর্যায়ে পড়ে না। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, ময়ূর-২–এর চালকের গোঁয়ার্তুমি ও অদক্ষতার জন্য দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এর পাশাপাশি লঞ্চের কারিগরি কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা–ও খতিয়ে দেখতে হবে।

অতীতে অনেক দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কী অনুসন্ধান করেছে, কী সুপারিশ করেছে, তা দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে গেছে। প্রভাবশালী লঞ্চমালিকেরা যেমন তদন্তকাজে, তেমনি কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নেও বাধা দিয়ে আসছেন। আমরা আশা করব, এবার তার পুনরাবৃত্তি হবে না। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে বের করা না গেলে কিংবা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে নৌপথে শৃঙ্খলা আনা যাবে না।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধ্যাদেশে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত আছে, প্রভাবশালী নৌযানমালিকেরা সেসব মানেন না, নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নৌপথে নিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বড় দুর্ঘটনা না হলে খবর হয় না। কর্তৃপক্ষেরও ঘুম ভাঙে না।

সরকার দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছে। যঁারা গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার দায়িত্বও সরকারের নেওয়া উচিত।

ভবিষ্যতে যাতে এভাবে নৌপথে মানুষকে বেঘোরে মরতে না হয়, সে জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আইনের ফাঁকফোকর কিংবা প্রভাব–প্রতিপত্তি খাটিয়ে যেন কেউ পার না পায়।