সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মমতার অবদান

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রয়টার্স
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: রয়টার্স

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তারও তিন বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। মমতা যে সময়টায় পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেন, সেই সময়টায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ঘটনাবলির পাশাপাশি সাচার কমিশনের প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের দুরবস্থা ঘিরে রাজনৈতিক মহল বেশ সরগরম ছিল। বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা সংখ্যালঘু স্বার্থ ঘিরে বেশি যত্নবান—এমন একটা প্রচার ভোটের আগে বেশ জোরদার হয়েছিল। বিশেষ করে রিজয়ানুর নামের এক মুসলমান যুবকের হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেমঘটিত আত্মহত্যাকে ঘিরে রাজনীতি মমতাকে সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে একটা প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।

মমতা ক্ষমতায় এসেই আন্তর্জাতিক সমস্ত আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রকাশ্যে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে না দেওয়ার কথা বলেন। মমতা ক্ষমতায় আসার প্রথম তিন বছর ভারত সরকারের মূল পরিচালক ছিল কংগ্রেস। এই দল তাদের অতীতের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক সহবত অনুসারে তিস্তার পানির ন্যায্য প্রাপ্য বাংলাদেশকে দিতে তৎপর হলেও ভারতীয় রাজনীতির যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত তা আর সফল হয় না।

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই হিন্দু-মুসলমানের ভেতরে সার্বিক বিভাজন তৈরি করে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় যে নতুন করে উত্তেজনার পরিমণ্ডল তৈরি করেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তিকে চাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তার সার্বিক পটভূমিকা তৈরিতে মমতার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যে রাজনৈতিক লক্ষ্য সামনে রেখে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় সমস্যা তৈরি করে এই অঞ্চলকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবাধ বিচরণভূমি তৈরির চেষ্টায় বিজেপি আত্মনিয়োগ করে, সেই জমির উপযোগিতা মমতাই তৈরি করে রেখেছিলেন।

প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন মমতা। যার ফলে মমতার ছদ্ম সংখ্যালঘুপ্রীতি, যা আসলে তাঁর দলের সিন্ডিকেটভুক্ত সামান্য কিছু ধর্মের কারবারিকে যৎসামান্য পয়সাকড়ি পাইয়ে দিয়ে প্রতিবেশী ধর্মের সাম্প্রদায়িক নয়, এমন ধর্মপ্রাণ মানুষদেরও ঠেলে দিয়েছে মুসলিমবিদ্বেষের কোটরে। আর সেটিকে এনআরসি, সিএএ, সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ এ বাতিলসহ, যাবতীয় সংখ্যালঘুবিরোধী অবস্থান নিতে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে একটা অনুকূল পরিবেশ উপহার দিয়েছে।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক পরিকাঠামো বাতিল করে আরএসএসের আদর্শগত অবস্থানে যে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ রয়েছে, তাকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব ঘিরে এমন আইন আনতে চলেছে ভারতে; তা সংবিধানের মূল পরিকাঠামোবিরোধী। মমতা মুখে এই আইনের বিরোধিতা করছেন, কাজে নয়। কেরলের বামপন্থী সরকার এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেছে। তাদের এনপিআর বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির কাজ স্থগিত নয়, বাতিল করেছেন। আর মমতা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া তো দূরের কথা, এনপিআর বাতিল তো দূরের কথা, তাঁর রাজ্যের পৌরসভাগুলোর মারফত এই নাগরিক পঞ্জি তৈরির জন্য সাময়িক কর্মী নিয়োগের আদেশনামা জারি করেছেন।

কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা রুখতে কোনো পরিকল্পিত কর্মপন্থা ছাড়াই মোদি প্রশাসন মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে গোটা ভারতে লকডাউন করেছে। এই লকডাউনে প্রান্তিক মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিকেরা অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় পড়লেও কেরল ব্যতীত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারগুলো তাদের ঘিরে তেমন কিছুই ভাবেনি। করেনি। বরং উত্তর প্রদেশের মতো বিজেপিশাসিত সরকার দেশের প্রচলিত শ্রমিক আইন লঘু করে গোটা শ্রমিকসমাজকেই এই লকডাউনের সময়ে ভয়ংকর বিপদের ভেতরে ফেলেছে। মুখে বিজেপিবিরোধিতার কথা বললেও মমতা এসব নিয়ে একদম নীরব।

দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলিগের জামাত ঘিরে মুসলমানরা করোনা ছড়াচ্ছে—এই অবৈজ্ঞানিক প্রচার চালিয়েছে। এই প্রচার যে কেবল উগ্র সাম্প্রদায়িকদেরই প্রভাবিত করেছে, তা-ই নয়, মমতার প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে ভূমিস্তরে কাজ করা একাংশের বামপন্থী কর্মী–সমর্থকদেরও অনেকটাই প্রভাবিত করেছে। বস্তুত, আরএসএস-বিজেপির এই সামাজিক প্রযুক্তি এবং তাকে ঘিরে মমতার নীরব সমর্থন, এই গোটা অপকর্ম মোকাবিলায় শুরুর দিকে অনলবর্ষী মো. সেলিম ছাড়া আর কোনো শীর্ষস্তরের বাম নেতৃত্ব সরব হননি। যখন তাঁরা সরব হয়েছেন, ততক্ষণে বিভাজনের রাজনীতিতে বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মসূচি অনেকখানি সফল হয়ে গিয়েছে।

এ অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পান এবং দুর্গতদের ঘিরে মোদি-মমতার রাজনৈতিক দড়ি-টানাটানি। মমতার প্রশাসনিক অপদার্থতায় এবং ত্রাণ ঘিরে চরম দলবাজির ফলে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। মমতার সংখ্যালঘুপ্রীতির নামে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি একদম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ত্রাণ না পেয়ে মানুষের বিডিও অফিস ঘেরাওয়ের ভেতর দিয়ে। এ রকম একটা অবস্থায় প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার তাসকে আরও জোরদার করে খেলতে সংখ্যালঘু উন্নয়নের নাম করে মাদ্রাসা ইত্যাদির জন্য মমতা ৪ হাজার ১৬ কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছেন। মাদ্রাসার জন্য হরেক রকমের ঘোষণাও মমতা বিধানসভার ভোট যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, এমন সময়ে করেছেন।

বামফ্রন্ট সরকার ’৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির বাস্তব প্রয়োগে তাদের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে পর্যায়ক্রমে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করেছিল। আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে সংগতি রেখে সেই আধুনিকীকরণ ভারতের সীমা অতিক্রম করে আরব দুনিয়ার কাছে পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। বামফ্রন্টের আমলে মো. সেলিমের স্বল্পকালীন মন্ত্রিত্বে সংখ্যালঘু উন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থানে গোটা ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সংখ্যালঘু নারীর কর্মসংস্থানে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের মাধ্যমে সেলিমের সাফল্য তৎকালীন অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারও স্বীকার করেছিল খোদ ভারতীয় সংসদে।

মমতার দ্বিমুখী রাজনৈতিক চরিত্র কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় বাম আমলে কিদোয়াই কমিশনের সুপারিশে যে বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাক্রম চালু হয়েছিল, সেগুলো মমতার আমলে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ধর্মের ঘেরাটোপে মুসলমান সমাজকে আটকে রাখাটাই বিজেপির সুবিধা। সেই বন্দোবস্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে মমতার এ কৌশল। এভাবেই মুসলমানরা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন, ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের মধ্যে এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করে মুসলমানবিদ্বেষ সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের সুবিধা করে দেওয়াই মমতার রাজনীতি, যা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেও উসকে দিতে সাহায্য করবে। তিস্তার পানি আটকে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে অপ্রিয় করে সেখানকার মৌলবাদীদের খুশি করেছেন মমতা। বস্তুত, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে বিধ্বস্ত করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যে ষড়যন্ত্র, মমতা সেই ষড়যন্ত্রেরই শরিক হয়েছেন,যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও কাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

গৌতম রায়: পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।