যেভাবে বৈষম্য কোভিড-১৯-এ মৃত্যু বাড়াচ্ছে

বিশ্বে কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেকই (৪৬%) মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও মেক্সিকোয়। যদিও এই তিন দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ৮.৬ শতাংশ। ইউরোপে মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশই ঘটেছে অন্য তিনটি দেশে—ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে। অথচ ইউরোপের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩৮ শতাংশের বাস এই তিন দেশে। তুলনায় উত্তর ও মধ্য ইউরোপে মৃত্যুর হার অনেক কম। 

কোনো দেশে কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর হার কত হবে, কতগুলো বিষয়ের ওপর তা নির্ভর করে। এগুলো হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান, সরকারি তৎপরতায় সামঞ্জস্য, হাসপাতালে বিছানার প্রাপ্যতা, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের মাত্রা, এবং জনসংখ্যার বয়সকাঠামো। তবে এসবের ভূমিকা কী হবে, তা আবার ঠিক হয় কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে। দেশের আয় ও সম্পদের বণ্টনের ধরন হলো সেই কাঠামোগত চরিত্র। 

যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও মেক্সিকোয় আয় ও সম্পদের বৈষম্য মারাত্মক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের গিনি সহগ ৪১.৪, ব্রাজিলে ৫৩.৫ এবং মেক্সিকোয় ৪৫.৯। (গিনি সহগ ১০০ পয়েন্টের একটি পরিমাপ। ১০০ মানে সব সম্পদ ও আয় একজনের হাতে ঘনীভূত এবং শূন্য হওয়া মানে আয় ও সম্পদ বণ্টনে কোনো বৈষম্য নেই)। এই তিনটি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গিনি সহগ সর্বোচ্চ। আর ব্রাজিল ও মেক্সিকো সবচেয়ে বৈষম্যপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। ইউরোপে, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের গিনি মান হলো যথাক্রমে ৩৫.৬, ৩৫.৩ এবং ৩৪.৮। এই দেশগুলো উত্তর ও মধ্য ইউরোপীয় দেশ, যেমন ফিনল্যান্ড (২৭.৩), নরওয়ে (২৮.৫), ডেনমার্ক (২৮.৫), অস্ট্রিয়া ৩০.৩, পোল্যান্ড (৩০.৫) এবং হাঙ্গেরি (৩০.৫) চেয়ে বেশি বৈষম্যপূর্ণ।

প্রতি মিলিয়নে মৃত্যুর হারের সঙ্গে আয়বৈষম্যের সম্পর্ক অতটা নিবিড় নয়; অন্যান্য প্রভাবকও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ফ্রান্সের বৈষম্যের মাত্রা জার্মানির প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু করোনাভাইরাসে জার্মানির চেয়ে ফ্রান্সের মৃত্যুহার অনেক বেশি। তুলনামূলকভাবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সুইডেনে মৃত্যুহার এর প্রতিবেশীদের চেয়ে ভালোই বেশি। কারণ, সুইডেনে সামাজিক দূরত্বের নিয়ম বাধ্যতামূলক না করে বরং ঐচ্ছিক করা হয়েছিল। অন্যদিকে তুলনামূলক কল্যাণকামী রাষ্ট্র বেলজিয়ামে মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনেক ওপরে। কারণ, দেশটি করোনাভাইরাসে সম্ভাব্য ও নিশ্চিত উভয় মৃত্যুকেই একত্রে গণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। 

ভীষণ বৈষম্য অনেক দিক থেকেই এক সামাজিক ক্ষত। কেট পিকেট ও রিচার্ড উইলসন যুক্তিগ্রাহ্যভাবে দেখিয়েছেন, বৈষম্য যত বেশি, সার্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ততই নাজুক হয়। একই কারণে কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়। পাশাপাশি উচ্চ বৈষম্য মানে নিম্নতর সামাজিক সংহতি, কম সামাজিক বিশ্বাস এবং অধিকতর রাজনৈতিক বিভেদ। এই সবকিছু মিলে সরকারের দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য ও প্রস্তুতি কমিয়ে দেয়। উচ্চ বৈষম্য মানে নিম্ন মজুরির শ্রমিকের সংখ্যাধিক্য। যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে শ্রমজীবীদের কাজ চালিয়ে যেতে হয়। বেশি বৈষম্য মানে বেশিসংখ্যক মানুষ গাদাগাদি করে বসবাসে বাধ্য হওয়া। সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী নেতারা বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নির্বাচিত হয়েছিলেন বৈষম্যপূর্ণ ও সামাজিকভাবে বিভক্ত গোষ্ঠীদের দ্বারা। কিন্তু বিক্ষুব্ধদের নিয়ে রাজনীতি করা আর মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা একেবারে বিপরীত ব্যাপার। 

যুক্তরাষ্ট্র খুবই বৈষম্যপূর্ণ, রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এবং ট্রাম্পের অধীনে বাজেভাবে শাসিত। দেশটি জাতীয়ভাবে কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ মহামারি মোকাবিলার পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সব দায়দায়িত্ব চাপানো হয়েছে আঞ্চলিক রাজ্য ও স্থানীয় সরকারের ওপর। বিপুলভাবে সশস্ত্র বামপন্থীরা ব্যবসা ও ব্যক্তিগত বিচরণের ওপর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের রাজধানীতে বিক্ষোভ ও নৈরাজ্য চালিয়েছে। এমনকি মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টিকেও রাজনীতিকৃত করে ফেলেছেন ট্রাম্প। তিনি নিজেও মাস্ক ব্যবহারে নারাজ ছিলেন। ব্রাজিল ও মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিরই অনুকারক। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল লোপাজ ওব্রাডর ট্রাম্পের আদলেরই নেতা। পাশ্চাত্যে ব্যতিক্রম শুধু কানাডা। এ বাদে সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ভাইরাসের আক্রমণে বিধ্বস্ত।

বেশির ভাগ দেশেই বৈষম্য, সামাজিক অনাস্থা, দুর্বল সুশাসন এবং বিপুলসংখ্যক দরিদ্র জনগণ নিয়ে ভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে। আবার ভাইরাসের কারণেও বৈষম্য ও দারিদ্র্য আরও বাড়ছে। ধনীরা অনলাইনে ফায়দা তুলছে। আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের সম্পদ বছরের শুরুতে ৪৯ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। অন্যদিকে গরিবেরা কাজ হারাচ্ছে কিংবা ঝুঁকি নিয়ে কাজে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বৈষম্যের খেসারত বাড়ছে, সরকারগুলোও বাজেটে জনসেবা খাতের বরাদ্দ কেটে ফেলছে। হিসাব চোকানোর দিন আসছে। বিশ্বাসযোগ্য, যোগ্য ও সামাল দেওয়ার মতো সরকার না থাকায় পৃথিবী আবারও অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, বাড়ছে একগুচ্ছ বৈশ্বিক সংকট।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জ্যাফরি ডি স্যাকস যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক