সেবা-অন্তঃপ্রাণ অধ্যাপক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন স্মরণে

ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত
ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

গত ৭ জুন ঢাকার প্রসিদ্ধ স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) প্রধান এবং হাসপাতালের পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিস) অধ্যাপক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন (৫৭) করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইহধাম করেন। তিনি একজন জনহিতৈষী চিকিৎসক ও সেবক হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিনকে আমি আমার চিকিৎসক ও বন্ধু হিসেবে প্রায় ১১ বছর ধরে চিনি। বয়সে তিনি ছিলেন আমার ৩০ বছরের ছোট। আমার জীবনে অসুখ-বিসুখ তেমন ছিল না। শৈশবে পাঁচ থেকে ছয় বছর বয়সে হাঁটু ভেঙে একটি সার্জারি হয়েছিল বলে জানি। তার একটি দাগ সব সময়েই নজরে পড়ে। এরপর ছাত্রাবস্থায় আর্টিকেরিয়াতে কয়েক বছর ভুগি। গরু বা ছাগলের গোশত খেলেই গায়ে চুলকানি হতো আর রং লাল হয়ে যেত। এই ঝামেলা একেবারেই অকস্মাৎ বিদায় পেল। ১৯৫৩ সালে আমার দাদার চল্লিশাতে মেহমান খাওয়ানোর দাওয়াতে আমি কিছু খাব না বলে ঠিক করেছিলাম। তবে সেই ইচ্ছা আমার আম্মা, ফুপু ও বড় বোনের জারিজুরিতে টিকল না। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে সেদিন থেকেই আমার আর্টিকেরিয়া বিদায় নিল। আমি স্বাভাবিক মানুষের মতো গোশত খাওয়া আবার শুরু করলাম। পরবর্তী অসুখ হলো ১১ বছর পর, ১৯৬৪ সালে। আমি এক বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে দেশে ফিরেছি এবং করাচিতে আমার পদায়ন হওয়ায় সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ ভাইরাসবাহিত জ্বর আমাকে পেয়ে বসল। ডাক্তার ওয়াকিল আহমদ ওষুধপথ্য দিলেন আর বললেন যে জ্বর কমিয়ে রাখতে হবে। বাড়লেই মাথায় পানি ঢেলে জ্বর নামাতে হবে। প্রায় ১০ দিন আমার স্ত্রী সাবিয়া মুহিত ২৪ ঘণ্টা আজরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাকে সুস্থ করে তুললেন। এই হলো রোগ-বালাইয়ের আমার সারা জীবনের কাহিনি।

অবশেষে ২০০৯ সালে আমি দ্বিতীয়বার মন্ত্রী হয়েছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী। জুন মাসে বাজেট দেব। তারই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আমরা বিপুল ভোটে জিতেছি, তাই জনগণের আশাও গগনচুম্বী। মে মাসের মধ্যে আমি নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন প্রস্তাব সব গ্রহণের পালা। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক জরুরি। ১১ মে দুপুররাতে আমার হলো স্ট্রোক। আমি দেখলাম যে আমার মুখ হয়ে গেছে অপরিচিত। স্ট্রোকে তা বেঁকে গেছে। আমার বাড়িতে, হেয়ার রোডের ‘তন্ময়’ বাড়িতে আমার চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের ছেলে সাহেদ আমার বিটল ফক্সওয়াগনে আমাকে বসিয়ে নিয়ে গেল স্কয়ার হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে তার বন্ধু ছিল সহকারী জনসংযোগ অফিসার। সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমঝে নিল। আমাকে আইসিইউ কর্মকর্তা ডাক্তার মির্জা নাজিম উদ্দিন নিয়ে গেলেন এবং নানা পরীক্ষা শেষে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। দিবাগত রাত প্রায় তিনটায় বোধ হয় আমি স্কয়ার পৌঁছাই এবং পরদিন বেলা ১১টার দিকে ঘুম ভেঙে চোখ মেলি।

প্রথমেই আমার হুকুম হলো যে আমাকে একটি আয়না দেন। আমার উদ্দেশ্য হলো আমার বাঁকা মুখটি দেখা। দেখলাম যে না মুখটি আর বাঁকা নয়। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আপনাকে আমরা নাশতা খাওয়াব। কীভাবে ডিম খাবেন? চিনি কি খান? তারপর বললেন যে প্রধানমন্ত্রী খোঁজ নিয়েছেন এবং তিনি আসতে চেয়েছিলেন। তাঁকে তাঁরা জানিয়েছেন যে স্ট্রোক খুব সামান্য। তিনি ধীরেসুস্থে আসলেই ভালো। তাঁরা মনে করেন যে সাত থেকে দশ দিনে আমি হাসপাতাল ছাড়তে পারব। আমার বয়সের বিবেচনায় আমার একটি পরীক্ষা করা যায়নি, সেটার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে হবে। ধীরেসুস্থে পরীক্ষা হলেও চলবে—খুব তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই। আমার সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব—সবাই আমাকে দেখতে চান আর মির্জা সাহেব তা হতে দেবেন না। তিনি হাসিমুখে সবাইকে জানিয়েছেন, আমার স্ট্রোক খুব সামান্যই হয়েছে। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন এবং আমি সুস্থ হয়ে বাজেট পেশ করতে পারব। আমিও বেশ স্বস্তিবোধ করলাম যে আমি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বটি পালন করতে পারব। মনে মনে ঠিক করলাম, বাজেট বক্তৃতাটি বানাতে হবে। তারপরে সিঙ্গাপুরে যাওয়া যাবে। যে কদিন হাসপাতালে ছিলাম, প্রতিদিন কয়েকবার মির্জা সাহেব হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বেশ চাঙা রাখতেন। ভরসা দেওয়ার জন্য তিনি ছিলেন আদর্শ মানুষ। আর গত ১১ বছর সব সময়েই তাঁর ভরসার ওপর নির্ভর করেছি।

আমি ২০১০ সালের ১০ জুন সংসদে বাজেট উপস্থাপন করলাম। প্রায় চার ঘণ্টা দুবার বিরতি নিয়ে বক্তব্য পাঠ করলাম। ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাজেটের সারমর্ম সংসদ সদস্যদের সামনে তুলে ধরলাম। আমাকে বক্তৃতা প্রদানকালে সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী ও শেখ সেলিম সহায়তা করলেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহ প্রদান সম্বন্ধে নাইবা বললাম। আমার ভয় ছিল যে বক্তৃতা দানকালে আমি না কাহিল হয়ে পড়ি। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানিতে তেমন কিছু হলো না; বরং বক্তৃতা যতই পাঠ করতে থাকলাম, আত্মবিশ্বাস ততই জোরদার হতে থাকল। এবারেই বাংলাদেশের এবং পূর্ব পাকিস্তানের সর্বদীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা পেশ হলো। আমি নিজেও এর আগে দুটি বাজেট বক্তৃতা দিই। সেগুলো সোয়া ঘণ্টার বেশি কখনো ছিল না। আমার লম্বা বক্তৃতার খসড়া নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও মনে হয় কিছু দ্বিধা ছিল। কিন্তু বক্তৃতা যখন দিতেই থাকতাম, তখন বোধ হয় এই দ্বিধা এমনি বিদায় নেয়।

আমার ডাক্তার মির্জা সাহেবও সংসদে হাজির ছিলেন এবং মনে হয়, আমার নির্বিঘ্নে বক্তৃতা দেওয়া তাঁকে খুবই উৎসাহিত করে। মির্জা নাজিম উদ্দিন শুধু একজন চিকিৎসক বা হাসপাতালের পরিচালকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্যিকার জনসেবক এবং রোগীকে চাঙা রাখার দিকে সব সময় মনোযোগী। আমি সামান্য অসুবিধা হলেই তাঁকে ফোন করে উপদেশ নিতাম অথবা তাঁর দপ্তরে হাজির হয়ে যেতাম। আমি গেলেই তিনি তিনটি কাজ একই সঙ্গে সম্পন্ন করতেন। প্রথমে আমাকে এক কাপ কফি দেবেন। তারপর আমার ব্লাড প্রেশার মাপতেন। আমার রক্তে কত চিনি আছে, তা পরিমাপ করতেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সঙ্গে শেষ ডাক্তারি পরামর্শ নিই। আমার চিনি নিয়ন্ত্রণের জন্য দিনে আমি একটি ইনজেকশন নিই। সম্ভবত, ফেব্রুয়ারি মাসে বা তার সামান্য আগে তিনি আমার ২০ মাপের ইনজেকশনকে কমিয়ে ১৫ মাপে নামিয়ে দেন।

আমি সিঙ্গাপুরে যে ডাক্তারের পরামর্শ নিতাম, বছর পাঁচেক আগে তা বন্ধ করে দিই। কারণ, আমার মনে হলো যে আমার অবস্থা স্থিতিশীল এবং ডাক্তার মির্জাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমি মনে করি যে আমাদের রোগীরা খামাখাই ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যান। আমরা দেশে যে চিকিৎসা ও সেবা পাই, সেটাই উন্নত চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট। তার চেয়ে বেশি কিছু বিদেশে আশা করা নিতান্তই অর্থহীন। ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন টাঙ্গাইলের মানুষ এবং আমাদের খ্যাতনামা শিক্ষক অর্থমন্ত্রী ও কয়েক দিনের জন্য গভর্নর ড. মির্জা নুরুল হুদার ভাইপো। তাঁর স্ত্রীও স্কয়ার হাসপাতালেরই স্ত্রী ও প্রসূতি রোগবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক। তাঁরা দুজনেই সৌদি আরবে জেদ্দায় ডাক্তারি করেছেন এবং সেখানেই তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে একবার সৌদি আরব যান এবং তখনই আমি তাঁর জনপ্রিয়তার নিদর্শন পাই। তিনি আরও কতিপয় চিকিৎসক ও এনজিওর সঙ্গে মিলে ঢাকায় এয়ারপোর্টের কাছে একটি ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছেন এবং এই ইনস্টিটিউটই আমার মনে হয়েছে তাঁর শেষ জীবনের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পাক। স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলব যে আপনারা অধ্যাপক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন সাহেবের মতো একজন উপযুক্ত ডাক্তার ও ম্যানেজারকে খুঁজে নিয়ে আপনাদের সুনাম অক্ষুণœরাখার প্রচেষ্টা নেন। নাজিম উদ্দিন সাহেবের স্ত্রী, দুটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্য রইল আমার শোক এ সমবেদনা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী