পাটকল বন্ধের রাজনৈতিক অর্থনীতি

আমি একবার পাটমেলায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছিল সেবার। পাটজাত পণ্যের এত রকমের বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সেদিন প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম। ব্যাগ, শাড়ি, পর্দা, সোফা, গিফট বক্স, গয়না, ল্যাম্পশেড, কার্পেট, থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর নানান রকম উপকরণ ও শিশুদের খেলনায় এত বৈচিত্র্য আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। বহুদিন ধরেই শুনে আসছিলাম যে আমরা দেশীয় ও বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে পণ্যের ডিজাইন ও মানের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি। তাই আমি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই আশাবাদের কারণ শুধু এই নয় যে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচিত হবে, এই আশাবাদের কারণ ছিল এর মধ্যে দিয়ে অতীতের ধ্বংস হয়ে যাওয়া কর্মসংস্থানগুলো নতুন করে ফিরে আসবে। দেশের শ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটবে আর প্রতিটি পণ্যের বুননে বুননে সেই হাসি উদ্ভাসিত হতে থাকবে। মেলা থেকে কেনা পাটের ব্যাগ আর শাড়িটা অতি যত্নে ব্যবহার করেছি, এখনো করছি। এত মমতার কারণ হয়তো পাঠ্যবইয়ে পাটকে সোনালি আঁশ হিসাবে চেনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মনের পটে কৃষক-শ্রমিকের হাসিও একে নিয়েছিলাম সেই শৈশবেই। আর তাই পাট বললেই এর পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি এর পেছনের কৃষক-শ্রমিকদের জীবন জীবিকা দেখতে পাই।

এরপর বিভিন্ন সময় লক্ষ করেছি, পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া আদায়ের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছে, ভুখা মিছিল করতে হয়েছে, নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে অনশন করতে হয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জেনেছি, দীর্ঘদিন তাঁদের বেতন দেওয়া হয়নি লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে। এমনকি এই করোনাকালেও যখন বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁদের ওপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। আর সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি, ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের পাঁয়তারা করছে মন্ত্রণালয়। গত ২৮ জুন পাটমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে জানতে পারলাম, বন্ধের সিদ্ধান্ত ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, দেশ-বিদেশে যখন পাটের চাহিদা বেড়ে চলেছে, তখন ঠিক এই মহামারির মধ্যে এই পাটকলগুলো বন্ধ করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য কী? কিছুদিন আগেও না পড়লাম চামড়াশিল্পকে পেছনে ফেলে পাটশিল্প এগিয়ে? অনেকেই ভাবছেন, চারদিকে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লোকসান হচ্ছে, তাই টিকে থাকতে না পেরে করোনাকালে হয়তো এই পাটকলগুলোও লোকসানের কারণে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। কিন্তু যা ভাবানোর চেষ্টা করা হয়, তার পেছনেও আরও কিছু থাকে, যা সহজ চোখে ধরা পড়ে না। অর্থাৎ লোকসানের অজুহাতটি মোটেই এত সহজ ও সাধারণ নয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই লোকসান করে আসছিল। লোকসানের কারণগুলোও বহুদিন ধরেই জানা। বিভিন্ন সময়ে লোকসানের কারণ হিসাবে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, পাট ক্রয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব, আধুনিকায়নে গাফিলতি, বাজারজাতকরণে উদ্যোগের অভাব এগুলোকে চিহ্নিত করা হলেও এই ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন সময় শ্রমিকের বকেয়া বেতন দেওয়া হয়নি, পেনশনের অর্থ আটকে দেওয়া হয়েছে এবং পাটকল বন্ধ করে তা বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। এত দিন ধরে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত দেখলাম, দুর্যোগের সময় সংকটগ্রস্ত অর্থনীতির অজুহাত দেখিয়ে অযৌক্তিক ও অন্যায্য এই পদক্ষেপকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টায় এই সময়টাকে বেছে নেওয়া হলো।

২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বর্তমানে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের পিএফ জমা, গ্র্যাচুইটি এবং সেই সঙ্গে গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়নের সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক ও ২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সব বকেয়া পরিশোধ বাবদ সরকারি বাজেট থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। এতে শুধু প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হবেন না, এর সঙ্গে জড়িত অস্থায়ী শ্রমিক ও অন্যান্য মানুষের জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হবে। কর্মহীন হয়ে যাওয়া এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে আশ্বস্ত করতে গিয়ে পাটমন্ত্রী জানিয়েছেন, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে, শ্রমিকদের নিশ্চয়তা তো দেওয়াই হলো, আর বন্ধ করার মানে হলো নতুন করে চালু হওয়া। কিন্তু এই আশা দেখানো মোটেই এত সরল নয়।

প্রথমত, যেই কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে পাটকলের শ্রমিকদের সময়মতো বকেয়া বেতন পরিশোধ করতেই ব্যর্থ হয়েছে, সিন্ডিকেটের চক্র ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে, প্রতিবাদ সমাবেশ দমনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে, সেই কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ওপর শ্রমিকেরা ভরসা করবে কী করে? আর লোকসান কমানোর সমস্ত উপায় যখন জানা আছে, তখন অগণতান্ত্রিক উপায়ে নেওয়া এমন সিদ্ধান্ত তাঁরা কী কারণে মেনে নেবেন?

দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে যে নতুন পাটকলে চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে বলা হয়েছে, তার অর্থ আসলে কী? বিদ্যমান বেসরকারি পাটগুলো বেশির ভাগই অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে ও কম মজুরি দিয়ে খরচ কমিয়ে থাকে। বেসরকারি খাতে মাসিক মজুরি মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে মজুরি কমিশন বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত পাটকলগুলোর মূল বেতন ৮ হাজার ৭০০ টাকা নির্ধারণের পর এ বছর থেকে ২৬টি পাটকলের শ্রমিকদের ৮ হাজার ৭০০ টাকা মূল বেতন পাওয়ার কথা। অর্থাৎ বিজেএমসির শ্রমিকেরা চাকরিচ্যুত হলে বেসরকারি পাটকলে অস্থায়ীভাবে কাজ করতে হবে এবং তখন তাঁদের বেতন প্রায় তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দুটি বেসরকারি পাটকল মণ্ডল পাটকল ও সাগর পাটকলের মজুরি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এখানে অস্থায়ী শ্রমিকেরা সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করলে ১ হাজার ৩০০ টাকা, আবার পাঁচ দিন কাজ করলে ১ হাজার টাকা পান। একজন শ্রমিক পুরো মাস কাজ করলে তাঁর বেতন হয় ৫ হাজার ২০০ টাকা। আবার অস্থায়ী ভিত্তিতে এক দিন কাজ করলে প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১৬৫ টাকা পান। কেউ কেউ অন্য মিলে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পান। অর্থাৎ এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট স্কেল নেই। একটি শ্রমিক পরিবারের বাসস্থান, যানবাহন, চিকিৎসা, শিক্ষা বাবদ খরচ বাদ দিয়ে এবং খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান বাদ দিলেও শুধু এক দিনের খাবার খরচ ২০০ টাকা হয় (প্রতিটি পাঁচ সদস্যের পরিবারে যদি ২.৫ কেজি চালে ১০০ টাকা, ১০০ গ্রাম ডালে ১০ টাকা, ৫০০ গ্রাম আলু ১০ টাকা, ডিম/সবজিতে ৫০ টাকা, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, মসলায় ১০ টাকা এবং অন্যান্যতে ২০ টাকা খরচ ধরা হলে)। একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে কী করে একজন শ্রমিকের বেতন কোনো মতে টিকে থাকার খাদ্য খরচেরও কম হয়? কর্মহীন হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করে কেন পরে নতুন পাটকলে কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তা বোঝা খুব সহজ। বেসরকারীকরণের ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে, শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে পাটকলের মালিকদের লাভ বৃদ্ধি এর মূল উদ্দেশ্য। তাই ১৬৫ টাকা মজুরি আড়াল করে মধ্যম আয়ের দেশের মিথ্যা স্বপ্ন দেখায় পাটমেলার প্রদর্শনীতে। আর আমি তাই দেখে বোকার মতো অভিভূতও হয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য হলেও।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্প বেসরকারীকরণ করা হলেই যে সব অব্যবস্থাপনা দূর হয়ে যাবে, লাভ হবে, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কি? এর আগে পাটকল ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়ার নাম করে সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুটপাট করা, বিশাল জমি দেখিয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে না পারার নজির স্থাপন করা হয়েছে। এ রকম তিনটি পাটকল যেমন এজ্যাক্স, সোনালি, মহসিন পাটকল বন্ধের কথা সব শ্রমিকই জানেন। কাজেই এই বেসরকারীকরণের ওপর স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের আস্থা নেই।

চতুর্থত, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এর আগে কীভাবে প্রযুক্তিগত নবায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করে পাটকলের লোকসান কমানো যায়, তার একটি প্রস্তাব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করেছিল। তারা প্রস্তাব করেছিল, এই নবায়নের সময় পাটকল চার মাস বন্ধ রাখা অবস্থায় শ্রমিকেরা ৫০ ভাগ মজুরি নিতে প্রস্তুত। এর জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখারও প্রস্তাব দেয়। এর পাশাপাশি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করে নবায়ন বাবদ যে খরচ হবে, বাজার যাচাই করে তার একটি হিসাবও উপস্থাপন করে তারা। সেই হিসাবে ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেই এই পাটকলগুলোকে নবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো যায় বলে তারা দেখিয়েছে। অথচ আমরা দেখলাম, এই করোনাকালে অর্থসংকট দেখিয়ে ১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে নবায়নের পরিবর্তে বেসরকারীকরণের জন্য ৫ হাজার কোটি পর্যন্ত বাজেট থেকে খরচ করতে প্রস্তুত সরকার। এত দিনের বকেয়া মজুরি দিতে অসুবিধা হলে এখন হুট করে এত টাকা কোথা থেকে আসে? অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে পাটকল বন্ধ করে বেসরকারীকরণ করার ব্যাপারে সরকারের একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করা যায়। আর এর জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে করোনাকালকে বেছে নিতে তারা একটুও দ্বিধা করেনি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যেন এই লুটপাটের আকাঙ্ক্ষা চোখে না পড়ে, তাই এই তৎপরতা?

রপ্তানি যখন ঊর্ধ্বমুখী, যখন সারা বিশ্বে পাটের কদর বাড়ছে, পণ্য তৈরিতে বৈচিত্র্য বাড়ছে এবং বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, ঠিক তখনই দেখছি, বিজেএমসির অন্তর্ভুক্ত ২৬টি পাটকলের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমানে বিজেএমসির অবদান মোট উৎপাদনের ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। রপ্তানিতে এ হার কমে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে নেমেছে। কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে আলাপের সূত্রে জানতে পারলাম, সিন্ডিকেট শুধু বিজেএমসিকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা বাড়তি দামে পাট কিনতেই বাধ্য করছে না, মানসম্পন্ন পাট দিতেও অবহেলা করছে। কর্মরত পাটকলশ্রমিক বকেয়া বেতন না পেয়ে অর্থকষ্টে পড়ে একটি বেসরকারি পাটকলে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছেন যে বেসরকারি পাটকল উচ্চমানের পাট ক্রয় করলেও বিজেএমসির পাটকলগুলোয় নিম্নমানের পাট সরবরাহ করা হয়। এর ফলে উৎপাদন হ্রাস পায় এবং লোকসান বাড়ে।

ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছিল পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পাটের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। চাল, গম, আটা, চিনিসহ ১৮টি পণ্যের মোড়ক ব্যবহারে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আদেশ জারি হয়েছিল। এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের বাজারে পাটের বিপুল চাহিদার সৃষ্টি হওয়ার কথা। ইউরোপে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এর বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ ও পাটজাত মোড়কের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের যখন পাট খাতকে শ্রমিকবান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে পাট খাত সম্প্রসারণের কথা, তখন করোনাকালে বাংলাদেশ একে সংকুচিত করে, শ্রমিকদের কর্মহীন করে ভুল নীতির দিকে এগোচ্ছে। পাটের এই বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পাটকলগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করতে হবে। পাট ক্রয়ে সিন্ডিকেটের প্রভাব ভাঙতে হবে। এই সিন্ডিকেটের টিকে থাকার ক্ষমতার উৎস তাদের বিদ্যমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। পাটকল বন্ধও নয়, বেসরকারীকরণও নয়, বরং দুর্নীতি টিকিয়ে রাখার জন্য যে চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে বছর বছর লোকসানের পরিস্থিতি তৈরি করছে, তাকে সমূলে নির্মূল করার মধ্যে দিয়েই একমাত্র পাট খাত সম্প্রসারণ করা সম্ভব।

পাটমেলায় দেখানো স্বপ্ন দেখে অভিভূত হওয়া আমি আজকে শ্রমিকদের পরিস্থিতি দেখে অনুধাবন করতে বাধ্য হচ্ছি যে পাটশিল্প বিকাশের নামে সরকারগৃহীত নীতি কোনোভাবেই শ্রমিকবান্ধব নয়। ২৬টি পাটকল বন্ধের পেছনে রয়েছে শ্রমিক শোষণের এক মহাপরিকল্পনা। সোনালি আঁশের বুননে শ্রমিকের হাসির বদলে খুঁজে পাচ্ছি শ্রমিকপিতাদের শিশুকে মুখে পর্যাপ্ত খাদ্য দিতে না পারার তীব্র যন্ত্রণা। একজন সচ্ছল পিতা যখন পাটের ব্যাগ ভর্তি করে নিজের শিশুর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য কিনবেন, আর পাটের ব্যাগের পেছনের কারিগরেরা যখন সন্তানের জন্য সবচেয়ে সস্তা পুঁটি মাছটাও কিনতে না পেরে খালি ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরবেন, তখন পাটমেলায় প্রদর্শিত পণ্যের উন্নয়ন-চাকচিক্য এক নিমেষে বিলীন হয়ে যাবে।

মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।