বন্যার কবলে উত্তরাঞ্চল

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ধস যেন বাংলাদেশের মানুষের ললাটলিখন হয়ে পড়েছে। গত মে মাসে দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এ ঘূর্ণিঝড় এতটা বিস্তৃত ছিল যে উপকূলীয় এলাকা পেরিয়ে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় আঘাত হেনেছে। এতে ফসল ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 

 এ ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই বন্যার প্রকোপ দেখা দিয়েছে উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলায়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানটিই এমন যে উজানে ভারী বৃষ্টি হলে এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। আবার শুকনো মৌসুমে উজান থেকে পানি না এলে বাংলাদেশকে খরার কবলে পড়তে হয়। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারত থেকে প্রবাহিত। কিন্তু গঙ্গা ছাড়া অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের অব্যাহত চেষ্টা সত্ত্বেও। 

 চলতি বছরের মে-জুন মাসে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এর সঙ্গে উজানের ঢল যুক্ত হওয়ায় বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে নিম্নভূমি ও চরাঞ্চল। ভারতের আসাম, মেঘালয়সহ হিমালয়ের পাদদেশে দিনে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। 

আবহাওয়াবিদদের মতে, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এবার শক্তিশালী মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে। এর ফলে ভারতীয় অংশে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের দিনে এই বৃষ্টি আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত বন্যার আশঙ্কা আছে। 

 ইতিমধ্যে বন্যায় যেসব জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, সেগুলো হলো কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী। প্রথমে তিস্তায় পানির তোড় বেশি হলেও এখন কমতে শুরু করেছে। তবে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বেড়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের মানুষ। এসব নদীর পানি নামতে শুরু করলে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুরেও হালকা বন্যা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে আসাম ও মেঘালয়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চল প্লাবিত হবে। 

তাই বন্যা মোকাবিলা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারকে এখনই জোরদার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বিশেষ করে দেশে এখন করোনার প্রকোপ চলছে। তাই পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলো সাজাতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, যাতে সেখানে গিয়ে নতুন করে কেউ সংক্রমিত না হন। 

বন্যায় উল্লিখিত জেলাগুলোর কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের ফসলি জমি ডুবে গেছে। ফলে তারা খুবই বিপন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। করোনার কারণে জীবিকা হারানো অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন। স্থানীয়ভাবেও অনেকের আয়রোজগার বন্ধ। এমন অবস্থায় এ বন্যা অনেকের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জেলা প্রশাসন এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এদের শুকনো খাবারসহ কিছু কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রয়োজন ও সরবরাহের মধ্যে বিরাট ঘাটতি। অতীতে তালিকা নিয়েও নয়ছয় হয়েছে। অর্থাৎ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত লোককে বাদ দিয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত লোককে দেওয়া হয়েছে। এবারও যেন এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। 

বন্যায় উত্তরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কৃষি পুনর্বাসনের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে কৃষকেরা যাতে আগামী আমনের চাষ নির্বিঘ্নে করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এসবের প্রস্তুতি এখন থেকেই নিয়ে রাখতে হবে।