করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কেরালা কেন সফল

প্রথম আলোর (২৭ জুন ২০২০) একটি সাম্প্রতিক শিরোনাম, ‘করোনা মোকাবিলায় কেরালার প্রশংসায় পঞ্চমুখ অমর্ত্য সেন ও নোয়াম চমস্কি’। শিক্ষা ও মানব উন্নয়ন সূচকে কেরালার অগ্রসর অবস্থানকেই সাধারণত এর মূল কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে কেরালার সফলতার পেছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যার অন্যতম হলো একটি কার্যকর গ্রাম পঞ্চায়েতব্যবস্থা এবং কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে এটিকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। 

বহু বছরের প্রচেষ্টায় কেরালায় ত্রিস্তরবিশিষ্ট একটি কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যার সুফল পাওয়া গেছে বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারিকালে। গ্রামীণ পর্যায়ে কেরালায় ৯৪১টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৫২টি ব্লক পঞ্চায়েত ও ১৪টি জেলা পঞ্চায়েত রয়েছে। শহর পর্যায়ে ৮৭টি মিউনিসিপ্যালিটি ও ৬টি করপোরেশন রয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতের জনসংখ্যা গড়ে ২৫ হাজার। কেরালায় গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মচারীর সংখ্যা ১০-২৫ জন হলে তাঁদের অধীনে যে ৭-১৩টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যার মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত, তাদের কর্মচারীর সংখ্যা গড়ে ২০০ জন। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারী মাত্র একজন এবং তাঁদের নিয়ন্ত্রণে সম্পদের পরিমাণও অতি সামান্য। 

কেরালায় ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সরাসরি সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে পঞ্চায়েতপ্রধান ও সহপ্রধান নির্বাচন করে থাকেন। সংরক্ষিত আসনে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন এবং তাঁরা সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিতদের মতো একই ধরনের দায়দায়িত্ব ও ক্ষমতা ভোগ করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং তাঁরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হবেন, তা অকল্পনীয়। পক্ষান্তরে চরমভাবে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের বর্তমান স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় এসেছেন। দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে তাঁদের অধিকাংশই মনোনয়ন–বাণিজ্যের শিকার। তাই বর্তমান দুর্যোগের সময়ে প্রায় ১০০ জন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় আমরা অবাক হইনি। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে যে দুর্নীতি, লেনদেন ও দলবাজির কাঠামো গড়ে উঠেছে; তাতে দুর্নীতিতে যুক্ত না হয়ে মেম্বার-চেয়ারম্যানের পক্ষে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব। 

কেরালার সাফল্যের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া ‘পিপলস প্ল্যানিং’ ক্যাম্পেইন বা স্থানীয় পর্যায়ে গণপরিকল্পনা প্রণয়নের একটি সর্বব্যাপী আন্দোলন। এর অংশ হিসেবে রাজ্যের উন্নয়ন বাজেটের ৩৫ শতাংশ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হয়। এ আন্দোলন ডিপার্টমেন্ট অব লোকাল সেলফ-গভর্নমেন্ট ও স্টেট প্ল্যানিং বোর্ডের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, যার ফলে কেরালার পঞ্চায়েতব্যবস্থার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত গভীর হয় এবং জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতে পঞ্চায়েতব্যবস্থার ভূমিকা মুখ্য হয়ে ওঠে। জনকল্যাণের এই ভূমিকার অংশ হিসেবেই প্রতিটি পঞ্চায়েত একটি ‘দুর্যোগ’ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে, যার উদ্দেশ্য হলো সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিরা যাতে একই ‘কমান্ড ও কন্ট্রোল’–এর অধীনে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফার্স্ট রেসপন্ডারের একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়। আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য তাদের এলাকার সব প্রাসঙ্গিক তথ্য সন্নিবেশিত করতে হয়। ২০১৮ সালের বন্যা মোকাবিলায় এ পরিকল্পনা কাজে লাগানো হয় এবং সে অভিজ্ঞতার আলোকে আপৎকালীন পরিকল্পনাকে আরও কার্যকর ও যুগোপযোগী করা হয়। 

করোনাভাইরাস মহামারির শুরুতেই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্বাচিত সদস্যের নেতৃত্বে ‘র‍্যাপিড রেসপন্ডার’ বা দ্রুত সহায়তাকারী টিম গঠন করা হয়। সব স্বাস্থ্যকর্মী, পঞ্চায়েতকর্মী ও স্বাস্থ্য খাতের স্বেচ্ছাসেবীরা এই টিমের অংশ। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য কেরালায় ৩ লাখ ৩৭ হাজারের একটি স্বেচ্ছাসেবী টিম গড়ে তোলা হয়। 

বর্তমান দুর্যোগের সময়ে দ্রুত সহায়তাকারী টিমের সদস্যরা মোটা দাগে তিনটি কাজ করেছেন: যোগাযোগ, সমন্বয় (পরিকল্পনা প্রণয়ন যার অংশ) ও কমিউনিটির সম্পৃক্তকরণ। যোগাযোগের অংশ হিসেবে তাঁরা মানুষকে হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা ওয়েবসাইট তৈরি করে তাকে তথ্যভান্ডারে পরিণত করেছেন, যা থেকে নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় ও সঠিক তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা আরও গড়ে তুলেছেন কল সেন্টার, হেল্প ডেস্ক ও অনলাইন কাউন্সেলিংয়ের আয়োজন। 

দ্রুত সহায়তাকারী টিমের সদস্যরা যাঁরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করেছেন এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত ও সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে তা তদারক করেছেন। এ ছাড়া তাঁরা মোবাইল ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। 

তাঁরা ওষুধ এবং অন্যান্য জরুরি ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বাড়িতে বাড়িতে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁরা কমিউনিটি কিচেন স্থাপন করে যাঁদের খাদ্যের প্রয়োজন, তাঁদের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁরা গ্রোসারি স্টোর ও মাছের বাজারের মাধ্যমে যাতে করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারে, সে লক্ষ্যে বিশেষ নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। 

দ্রুত সহায়তাকারী টিমের লক্ষ্য ছিল জাতি-ধর্ম-দল-মতনির্বিশেষে সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যা কেরালার ঐতিহ্য। একই সঙ্গে তাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের জন্য বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে গঠিত এই টিম পুরো কমিউনিটিকে সংগঠিত করেই এসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এলাকার জনগণের আস্থা, সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার ফলে তারা সফল হয়েছে। কমিউনিটির পক্ষ থেকেও ভাইরাসের বিস্তার রোধে তাদের নিজ নিজ এলাকায় চেকপোস্ট স্থাপন করেছে। রাজ্যের সব প্রতিষ্ঠান এ কাজে যুক্ত হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন নির্বাচিত পঞ্চায়েত নেতারা। 

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে কেরালার রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে আস্থায় নিয়ে একটি বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রতিদিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন এবং কোনোরূপ লুকোচুরি না করে নাগরিকদের কাছে সব তথ্য উপস্থাপন করেন। এর থেকে সৃষ্ট পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক কেরালায় সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। আরও ভূমিকা রেখেছিল রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে (১৩ জুন ২০২০) লেখা এক নিবন্ধে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিরারাই ভিজেয়ান বলেন, ‘কোভিড-১৯-এর মতো মহামারির সময়ে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক হওয়া উচিত শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য ও গঠনমূলক। একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় যা সম্ভব নয়, যেখানে এমনকি ক্ষুদ্র সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে, যা জনগণের থেকে বহু দূরে...এটি সাবসিডিয়ারিটি তত্ত্বের পরিপন্থী, যে তত্ত্ব অনুযায়ী জনগণের কাছের স্তরের পক্ষে অনেক ভূমিকা আরও কার্যকরভাবে সম্পাদন করা সম্ভব। আমাদের মতে, একটি সংক্রামক ব্যাধি যা দ্রুত কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে কমিউনিটির অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে।’ 

ড. বদিউল আলম মজুমদার দি হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর