বরাদ্দের গোঁজামিল থেকে মুক্তির উপায় কী

অর্থবিলে যৎসামান্য পরিবর্তন এনে জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও বাজেট পাস হয়েছে। সংসদে কখনোই বাজেট বা অর্থবিল নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয় না। এবার কোভিড সংকটে প্রায় নাস্তানাবুদ অবস্থার মধ্যেও একটি পূর্ণ অর্থবিল ও বাজেট পেশের জন্য অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এবার না হয় করোনাকাল, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা অফিস করতে পারেননি, কিন্তু সব বছরেই অর্থবিল বা বাজেটে এত গোঁজামিল কেন থাকে? এই গোঁজামিল থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় আছে?

আমরা প্রায়ই দেখি, বাজেটে এক খাতের মধ্যে অন্য খাতের প্রকল্প কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নতুন বাজেট, সংশোধিত বাজেট আর আগের বছরের চূড়ান্ত বাজেটে থাকে অনেক ফারাক। যেসব খাত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বরাদ্দ বাড়ানোর চাপ রয়েছে, সেসব খাতেই তড়িঘড়ি করে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানো হয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি সব সময়ই এই আলোচনায়। এবারের বাজেটেও সবচেয়ে বড় বরাদ্দ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী আর শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। এমনকি বরাদ্দ তেমন না বাড়িয়েও কৌশল করে স্বাস্থ্যকেও বড় ও অগ্রাধিকার খাত বলা হয়েছে।

সেই নবম শ্রেণিতে ক্যাডেট কলেজে জাকেরউল্লাহ স্যার পড়িয়েছিলেন-বাজেট মূলত সরকারের আয়-ব্যয় পরিকল্পনার দলিল। কানাডা বা ডেনমার্কের মতো বাংলাদেশ ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ নয় । তারপরও বাজেটকে অনেকটা মানবদরদী করার জন্য অর্থমন্ত্রী পরম্পরায় বাজেটে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ রেখেছেন। দেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় মানুষ থাকার কারণে প্রতিবছরই এর বরাদ্দও বেড়েছে। দেশের ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৪৫টি কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ করছে। এর মাধ্যমে গরিব, বঞ্চিত, বয়স্ক, পিছিয়ে পড়া, কর্মহীন, প্রতিবন্ধী—এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে সরকার নগদ ভাতা বা খাদ্যসহায়তাও দিয়ে আসছে। করোনাভাইরাসের কারণে এই খাতে বরাদ্দ আরও বাড়াতে নানা মহল থেকেই দাবি ছিল।

চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, এই খাতের বরাদ্দ প্রস্তাবিত বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর জিডিপির ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই একে একধরনের চালাকি বা অন্যায্য বলেছেন। অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের টাকাও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে ৬ লাখ ৩০ হাজার পেনশনভোগীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এটাই সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণ। দুজন সাবেক অর্থসচিবকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে একজন বলেন এটা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আরেকজন বলেন, আগে এসব বরাদ্দের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাঁরাই অনেকটা গুছিয়ে স্বচ্ছতা দিয়েছেন। এবার নতুন করে সঞ্চয়পত্রের সুদের একটি অংশকেও এ খাতে দেখানো হয়েছে। পরিমাণটি ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। সংবাদপত্রের সূত্রমতে ব্যাখ্যাটা হচ্ছে মানুষ ব্যাংকে আমানত হিসেবে অর্থ না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনলে যে বেশি সুদ পায়, তা বহন করতে হয় সরকারকে। সুতরাং এটা সামাজিক নিরাপত্তা খাতেরই অংশ। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন ও সঞ্চয়পত্রেই ব্যয় হয়ে যাবে করোনাকালের সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের প্রায় ৩১ শতাংশ।

যেসব দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আছে এবং বেসরকারি খাতও যার অন্তর্ভুক্ত, সেসব দেশে পেনশন ব্যয়কে এ খাতের মধ্যে দেখানো হয়। আমাদের দেশে যেহেতু এখনো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়নি, তাই সরকারি কর্মচারীদের পেনশন সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটে আসা যুক্তিযুক্ত নয়।

শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ, ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বরাদ্দ ৬৬ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের ১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা ঢুকিয়ে শিক্ষা খাতের হিসাবটি বেশ বড় করে দেখানো হয়েছে। এর ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকাও এখন শিক্ষা বাজেটের অংশ। এডিপিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হাওর এলাকায় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ইমামদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্পও দেখানো হয়েছে শিক্ষা খাতে।

স্বাস্থ্য খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ১১ জুনের বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। কিন্তু বাজেট দলিলে দেখা গেছে, বরাদ্দ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।

করোনা উপলক্ষে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে সরকার ২ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ ব্যয় সমন্বয় করলে স্বাস্থ্য খাতে এবার সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ২২ কোটি টাকা। আমরা শুনেছি করোনা নিয়ন্ত্রণে জরুরি থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মূল বাজেট দলিলে এ নিয়ে কোনো অঙ্ক দেখতে পাইনি। এ সবকিছু নিয়েই এবার স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের বেশি করা হয়েছে।

কৃষি খাতের ভর্তুকিও অর্থমন্ত্রী একাধিক জায়গায় দেখিয়েছেন। করোনা প্রণোদনা ঘোষণার সময়ই আমরা জেনেছি, ভর্তুকির পরিমাণ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রতি অর্থবছরেই কৃষি ভর্তুকি হিসেবে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা রাখা হয়। নতুনভাবে এটাকে দেখানোর কী প্রয়োজন ছিল, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

অর্থবিল বা কর খাতের দিকে তাকালে পৃথিবীর কোথাও বাংলাদেশের মতো তৈরি পোশাক খাত, পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত–অনিবন্ধিত নয় ব্যবসা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, টেলিকম কোম্পানি, টোব্যাকো কোম্পানির জন্য আলাদা আয়কর বা করপোরেট কর নেই।

অনিবন্ধিত প্রাইভেট কোম্পানির আয়কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ করে হলেও তাদের প্রচার ও ভ্রমণকে করের আওতায় আনায় বেশির ভাগ পণ্যের প্রচারমুখী কোম্পানির কার্যকর আয়কর দাঁড়াবে ৪২ শতাংশ। করের স্ল্যাব কমিয়ে অপেক্ষাকৃত ধনীদের কিছুটা বিনিয়োগের স্বস্তি দেওয়া হয়েছে বললেও সম্পদ কর, ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আর গাড়ির ওপর কর বাড়িয়ে তাদের তিন স্তরের ঝামেলার মধ্যেও ফেলে দেওয়া হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কী প্রয়োজন ছিল হাত ঘুরিয়ে ভাত খাওয়ার? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন বাজেটকে আরও স্বচ্ছ, জনবান্ধব, করদাতাবান্ধব এমনকি নতুন নতুন সক্ষম করদাতা খুঁজে বের করার চেয়ে কেন বছরের পর বছর ধরে চলছে এই লুকোচুরি আর গোঁজামিল। পরিবর্তন আনতে হবে আমরা যেভাবে রাজস্ব পরিকল্পনা করি কিংবা বাজেটকাঠামো দাঁড় করাই তাতে। এবং শিগগিরই। জাতির আর্থিক দলিল ও পরিকল্পনা নিয়ে আরেকটু মনোযোগী আমরা হতেই পারি।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক