পাটকল বন্ধ, পাটচাষির কী বিধান

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

সরকারি পাটকলের দরজায় তালা লাগানোর ঘোষণায় যে যে যার যার শ্রেণিমতো উদ্বিগ্ন। পাটকলশ্রমিকদের ন্যায্য দাবির পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। কথিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে চারটি দাবিসহ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে: 

১. রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে অবিলম্বে চালুর আদেশ দেওয়া হোক।
২. শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হোক ও তাঁদের করোনাঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
৩. সময়মতো পাট কিনে, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করে এবং পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে লোকসান কমানো হোক। পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হোক।
৪. কয়েক দশক ধরে লোকসানের অজুহাত দিয়ে একের পর এক পাটকল বন্ধ বা বেসরকারিকরণ করা হয়েছে, কিন্তু লোকসানের জন্য দায়ী মন্ত্রী, আমলা ও কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে বিচার করা হয়নি। লোকসান ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ এবং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।

বলা বাহুল্য, এসব দাবির একাডেমিক মূল্য থাকলেও সরকার বা মন্ত্রীদের কাছে এগুলো নিতান্তই ‘বাত কি বাত’।

শ্রমিক ভাইয়েরা মিলের সামনে পরিবার–পরিজন নিয়ে ধরনায় বসেছিলেন। দফায় দফায় বসেছেন শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে। মন্ত্রী তাঁদের টাকার তোড়া দেখিয়েছেন। বলেছেন, একেকজন শ্রমিক পাবেন কম করে হলেও ১২ লাখ টাকা, ৫০–৫৫ লাখও পাবেন কেউ কেউ। ইঙ্গিত দিয়েছেন, কে কত কীভাবে কখন পাবে না–পাবে—সেসব নিয়ে আলাপ–সংলাপ হতে পারে, কিন্তু যাঁরা আছেন, তাঁদের যেতেই হবে। রাজনীতি করা মানুষ এবার এটাও বলেছেন, মিলের দরজা খুলুক না–খুলুক, আলোচনার দরজা খোলা থাকবে। ঠিক যেমন ভুট্টো-ইয়াহিয়া বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। বাইরে–ভেতরে যে আলোচনা চলছে, তার নজির মেলে শ্রমিকদের ঘোষিত কর্মসূচি বন্ধের ঘোষণায়। ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করলে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন শ্রমিকের প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, ভবিষ্যৎ তহবিলের জমা, গ্র্যাচুইটি আর গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে আগাম অবসরের সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। অর্ধেক পাবেন সঞ্চয়পত্রে, বাকিটা নগদে।

২০১৪ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ৮ হাজার ৯৫৪ জন শ্রমিকের প্রাপ্য সব বকেয়া পরিশোধের ব্যবস্থা থাকছে এই পরিকল্পনায়। এসবের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এত যজ্ঞ-প্রস্তুতি দেখে মনে হয় না পাটকলশ্রমিকেরা কলের তালা খুলতে পারবেন। স্বপ্ন সার্থক হলে প্রিয়জনদের তালিকায় নাম থাকা লোকদের কবজায় চলে যাবে এসব কলকারখানা। বলা হবে পাবলিক-প্রাইভেট সহযোগিতা। সীমিত বেতনে সীমিতসংখ্যক শ্রমিক নিয়ে সীমিত আকারে স্বাস্থ্য বিধি আর অর্থবিধি মেনে, সরকারি প্রণোদনার ঘোড়ায় চেপে, কোনো এক নির্বাচনের আগে বেলুন উড়িয়ে দু–একটা হয়তো খোলা হবে। বিদায়ী শ্রমিকেরা বেঁচে থাকলে ঘরে বসে বা মোবাইলে সেসবের রঙিন ছবি দেখতে পাবেন। সেসব পরের কথা, কিন্তু পাটচাষিদের কী হবে?

পাট নিয়ে চাষিরা কোথায় যাবে
পাটকল বন্ধ মানে পাট কেনা বন্ধ। কোথায় যাবেন চাষি পাট নিয়ে? করোনা–আক্রান্ত পৃথিবীকে আবার লাইনে আনার জন্য যখন কৃষিকে সবাই গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন পাটচাষিদের পেটে লাথি কেন? পাটমন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রী—উভয়ের কথাবার্তা থেকে এটা নিপাট পরিষ্কার যে পাটের জমিতে জো আসার অনেক আগেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তা–ই যদি হয়, তাঁদের চিন্তায় কেন পাটচাষিদের কথা আসেনি। কৃষিমন্ত্রী কি ওয়াকিবহাল ছিলেন এসব পরিকল্পনার? যদি থাকেন, তাহলে কেন চাষিদের সে কথা জানিয়ে দেওয়া হয়নি। জানানো দূরে থাক, কৃষকদের কাছে হাসিমুখে তাঁদের বীজ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়েছে। ঘুণাক্ষরেও যদি এসব জানতেন, তাহলে তাঁরা এই শ্রমঘন ও নগদ পুঁজিনির্ভর চাষে যেতেন না। ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র পরিচালক কৃষিবিদ দেলোয়ার জাহান সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকার কৃষকদের সঙ্গে বসে হিসাব করে দেখেছেন, এবার প্রতি মণ পাটের খরচ পড়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। রাজবাড়ির পাংশা অঞ্চলের চাষিরা বলেছেন ১ হাজার ৬০০ টাকার কথা। ফরিদপুর–ময়মনসিংহ এলাকায় ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। কুষ্টিয়া ঝিনাইদহের সেচ এলাকায় একটু কম—তা–ও দেড় হাজার টাকার নিচে নয়। এই টাকার সবটাই তাঁদের ঋণের টাকা। আর পাট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এটা তাঁদের পরিশোধ করতে হবে।

মানিকগঞ্জের কোনো কোনো এলাকায় ইতিমধ্যেই পাট কাটা জাগ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। বরঙ্গগাইল আর জাফরগঞ্জের হাটে আগাম জাতের পাট কিছু কিছু এসেও পড়েছে। তবে পাইকারদের মধ্যে উৎসাহ একেবারেই নেই। পাইকারেরা পাট নিয়ে নানা পাটকলে সরবরাহ করে থাকেন। সরকারি পাটকলগুলোর পক্ষে বিজেএমসি এত দিন পাট কিনত পাইকারদের কাছ থেকে। এই মৌসুমে তাদের কী ভূমিকা হবে? পাইকারদের পাওনা গত মৌসুমের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পরে আছে। এক মাগুরার পাইকাররা পাবেন ১০ কোটি টাকা। সদরে তিনটি ও শ্রীপুর উপজেলার লাঙ্গলবন্ধে একটি—মোট চারটি কেন্দ্রের হিসাব এটি। গত মৌসুমে সারা দেশে ৫৭টি ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কিনেছিল বিজেএমসি।

বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে সাত থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, এর থেকে কমবেশি আশি লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। উৎপাদিত পাটের আঁশের প্রায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় এবং মাত্র ৫ শতাংশের মতো লাগে ঘর-গৃহস্থালি আর কুটিরশিল্পের কাজে। গত কয়েক বছর ধানের দাম না থাকায় কৃষকেরা ক্রমশ ঝুঁকছিলেন পাটের দিকে। ফরিদপুর আর কুষ্টিয়ার হিসাব পাশাপাশি রাখলেই সেই আলামত স্পষ্ট হবে। গত বছর (২০১৯) ফরিদপুরে পাট চাষের আওতায় ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই হাজার হেক্টর বেশি—প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর জমি।  তার আগের বছরেও (২০১৮) পাটের আবাদ বেড়েছিল।

২০১৯ সালে কুষ্টিয়ায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৫ একর। সেখানে চাষ হয় ৮৯ হাজার ৫৩৫ একর জমিতে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে মাত্র ৬৮ হাজার ৮১৩ একর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। একই ছবি দেশের সব কটি পাট উৎপাদনকারী জেলার। চাষি পরিশ্রম করে হলেও পাটের উৎপাদন বাড়িয়ে গিয়েছে।

চাষিরা বুঝতেই পারেননি, কোন ফাঁদে তাঁরা পড়তে যাচ্ছেন। তাঁরা ভরসা রেখেছিলেন পাটের সুদিন ফেরার খবরে। খবরটা মিথ্যা ছিল না। ২০১৮ সালের পাট দিবসে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের পাটচাষি কালাম মিয়া ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল পাটের সুতায় তৈরি শাড়ি এবং স্যান্ডেল পরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। পাট, পাটখড়ির বেড়া দিয়ে সাজানো হয়েছিল মঞ্চ। মঞ্চে ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও পাটসচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী। সবার পরনে ছিল পাটসুতার কাপড়ের তৈরি নীল রঙের ব্লেজার। সেদিনের অনুষ্ঠানে পাটের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য ১১ বিভাগে ১২ জনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। সবকিছু ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটা কথা কালাম মিয়ার দিলে ঢুকে গিয়েছিল, ‘পাটের বাজার খুলে গেছে।’ ফেরার পথে সারা রাস্তা তিনি সেটাই বলতে বলতে বাড়ি ফেরেন।

তাহলে কেন এমন হলো
পাটের মোকামের কাছে থাকা এক ব্যবসায়ীর ধারণা (ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা, এখন আওয়ামী লীগের প্রায় নিষ্ক্রিয় সদস্য), ‘এমন সময়ে সরকার পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, যখন অতি নিকটেই নতুন পাট বাজারে আসবে। এতে চাষি পাটের উৎপাদন খরচ পাবে না। দেশে এখন বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানার পাটকল আছে। তারা মিলের জন্য পাট খরিদ করবে, কিন্তু দাম দেবে না। চাষিরা হাটবাজারে এসে পাটের দাম না পেয়ে আহাজারি করবেন। অনেক চাষি হয়তো রাগে পাটে আগুন লাগিয়ে দেবেন। এই হলো আসছে পাট মৌসুমের চিত্র। এই সিদ্ধান্ত কে বা কারা সরকারকে দিল, বুঝে পাচ্ছি না। তবে অনুমান করছি, সরকার হয়তো দলীয় কোনো কোনো বিত্তবানের হাতে নামমাত্র মূল্যে এসব তুলে দিতে চাইছে। আমরা যারা শুধু দলকে সমর্থন করি, তারা এসবে লজ্জা পাই। জানি না কোন জ্ঞানদাতার দল পাটকল হাতছাড়া করার জ্ঞান দান করেছেন।’

চাষিকে বাঁচানোর কোনো পথ কি নেই
সব শুনে জাহাজের খবরাখবর রাখা এক ব্যবসায়ী জানালেন, ‘আমরা পুরোটাই রপ্তানি করে দিতে পারি। বাইরে অনেক চাহিদা। এক পশ্চিমবঙ্গ চাইলে সবটা নিতে পারে। ভারত ছাড়াও চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, নেপাল, আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে আমাদের কাঁচা পাটের বাজার আছে। আমাদের গাফিলতিতে সে বাজার ২০০৫-০৬ সালের তুলনায় এখন প্রায় অর্ধেকে নেমে এলেও পরিবেশের জিগির তুলে সেটা বাড়ানো সম্ভব। কোভিড সে সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের একটু উঠেপড়ে লাগতে হবে।’

এখন প্রশ্ন, আমরা চাষিকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লাগব, না বর্গিদের সুবিধা পাওয়ার কাজটাকে অগ্রাধিকার দেব?

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem 5508 @gmail. com