করোনা প্রতিরোধের সমবায়-কৌশল

আইসল্যান্ড ও তাইওয়ান। করোনা প্রতিরোধে এই দুটি দেশ অসামান্য সাফল্য দেখিয়ে তালিকার ওপরের দিকে আছে। তারপর ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। এই দেশগুলোর সাফল্যের পেছনে কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, তারা প্রায় একই ধরনের কৌশল নিয়েছে। কৌশলটি সহজ। রাষ্ট্রগুলো দেশের সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে করোনা প্রতিরোধের অন্যতম সামাজিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হতে দিয়েছিল। ইসরায়েলও এই সাফল্যপ্রাপ্ত। সাফল্যের অন্যতম ক্রীড়নক সমবায়ীদের জোট অ্যাজিক-নিস্পেড। কেরালার সাফল্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এখানেও দারুণ সক্রিয় সমবায় সমিতিগুলো। আসল কৃতিত্ব তাদেরই। তারা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সামাজিক সুস্বাস্থ্য রক্ষার পাহারাদারের ভূমিকা নিয়েছিল। জার্মানিতে সমবায়ীদের শীর্ষ সংস্থা ডিজিআরভির অসামান্য সক্রিয়তা, স্বেচ্ছাসেবা এবং সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল। করোনা জার্মানিকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি, ডিজিআরভিও সেই কৃতিত্বের অন্যতম হকদার।

স্পেনে সমবায়ীরা ধনবানদের কাছে উপর্যুপরি ধরনা দিয়েছে। ধনবানদের সামাজিক দায়িত্ব বিষয়ে অসামান্য সুফলও আদায় করে ছেড়েছে। লিওনেল মেসিকে দিয়ে এফসি বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের ৭০ ভাগ সম্মানী কমিয়ে নিতে সম্মত করেছে। এই সম্মানীর অর্থ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়াদের করোনাঝুঁকি কমাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতালিতে সমবায়ীরা সক্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছিল। ‘সম এনার্জিয়া’ নামের বিদ্যুৎ সমবায় তাদের সেবা-অঞ্চলে বিদ্যুৎ খরচ শতভাগ মওকুফের ঘোষণা দিয়েছে। সমবায়ভিত্তিক মন্ড্রাগসন অ্যাসেম্বলি এবং বেক্সেন মেডিকেল চিকিৎসকদের জন্য এক কোটি সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করেছে। ইতালিতে ৬৫-ঊর্ধ্ব বয়সীদের জন্য ট্যাক্সি সমবায়ীরা ট্যাক্সিসেবা এবং ভোগ্যপণ্য সমবায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিনা মূল্য করে দিয়েছে। সুইডেনের সমবায়ীদের নামধাম বলে শেষ করা যাবে না। কৃষিঋণ সমবায় ত্যারিম ক্রেদি, স্বাস্থ্য সমবায় একজ্যাকুপ—সব কটিই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় করোনাপ্রতিরোধী কর্মযজ্ঞকে ছাপিয়ে গিয়েছে। তুরস্কের বিখ্যাত কৃষি সমবায় প্যাংকোব্যার্লিক সুইডেনের কৃষি সমবায়গুলোর পার্টনার। প্যাংকোব্যার্লিক দিন-রাত নিরলস উৎপাদন করে চলেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মিটিয়ে সুইডেনের প্রয়োজনও মেটাচ্ছে সংস্থাটি।

করোনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা পাওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রই তাদের প্রতিরোধ পরিকল্পনার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রগুলো স্থানীয় ও আঞ্চলিক সমিতিগুলোকে স্বেচ্ছাসেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কাজে নিয়োজিতই করেনি, বরং স্বাধীনভাবে কাজ করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের আর্থিক প্রণোদনা সামান্যই ছিল। কেন্দ্রের কাছ হতে মর্যাদা এবং গুরুত্ব পাওয়াই ছিল সমবায়ীদের পাথেয়। প্রকৃতিগতভাবেই উৎসাহ-উদ্দীপনাই সমবায়-ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। সমবায়ীদের উদ্দেশ্য থাকে স্পষ্ট, মনোবল থাকে অটুট। সমবায়ীদের শক্তির উৎস পারস্পরিক নৈকট্যের সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ। সফল রাষ্ট্রগুলোর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিনির্ধারক মহল এই শক্তিকে অবহেলা করেনি। বরং উপযোগিতাটি চটজলদি উপলব্ধি করেছে। সমবায়-শক্তির যথাযথ প্রয়োগের বুদ্ধিমত্তাও দেখিয়েছে।

দুঃখের কথা এই যে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে সমবায়ী কর্মকাণ্ড প্রায় নেই বললেই চলে। স্থানীয় পর্যায়ে দেশি এনজিও এবং বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের যৎসামান্য সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড নজরে এলেও সেগুলো অনেকটাই নতুন মোড়কে তাদের নিয়মিত কর্মসূচিমাত্র। সেগুলো সময়ের দরকার মেটানো বিশেষায়িত কিছু নয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক কয়েক লাখ সমবায় আছে। যেসব এনজিও সেগুলোর তত্ত্বাবধান করে, তাদের ভূমিকা বলতে এটুকুই জানা গেছে যে কিস্তির সময় পিছিয়ে দেওয়া হবে। ঋণগ্রহীতাদের প্রতি নমনীয় ও মানবিক আচরণ করা হবে। একেবারেই হতদরিদ্রদের কারও কারও ঋণ মওকুফও করা হতে পারে।

অথচ করোনাকালে দরকার ছিল একটি সমন্বিত কর্মসূচির। করোনাকেন্দ্রিক বিশেষ কর্মসূচি ও কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগের প্রয়োজনই বেশি ছিল। বেশ কিছু পরিচিত এনজিও-সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছিলাম কেন তাঁরা অন্যান্য দেশের সমবায়ীদের মতো এগিয়ে এলেন না। কেউই মুখ খুলতে রাজি হলেন না। সরকার বা রাষ্ট্রের তরফেও সমবায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নজরে পড়েনি। উল্টো করোনা মোকাবিলাকে একটি কেন্দ্রীয়, আমলাতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় করে তোলা হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণ আধুনিক সামাজিক উন্নয়নের মূল শর্ত। যেসব দেশের উদাহরণ টানা হয়েছে, সেসব দেশের সমবায়গুলোর দুটি উল্লেখযোগ্য অর্জন ও সাফল্য আছে। এক, সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মধ্যস্থতা করা। দুই, বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক দায়বদ্ধতা (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) পালনে সম্মত ও সক্রিয় করা। বাংলাদেশের বেলায় এই দুটিই অনুপস্থিত।

মহামারি-অতিমারির আঘাত আরও আসবে—ওয়াকিবহাল মহল সে রকমটিই মনে করে। তেমনটি হলে বাংলাদেশের কেন্দ্রনির্ভর করোনা প্রতিরোধের বর্তমান জনবিযুক্ত কৌশলই যেন আবার ব্যবহৃত না হয়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যৎটিও যাতে ভীতিকর না হয়ে ওঠে, সে জন্য অন্যান্য দেশের সাফল্যের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

আজ ৪ জুলাই আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস। ১৯২৩ সাল থেকে প্রতিবছরের জুলাইয়ের প্রথম শনিবারকে আন্তর্জাতিক সমবায় দিবস নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সাহায্য সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী সমবায়গুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদন ঘাঁটলে বোঝা যায় যে এবারের মূল আলোচনাটি হবে করোনা কীভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাবে বা ঘটাতে পারে এবং সমবায়ীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। কোভিড-১৯ এই আলোচনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। প্রয়োজনটিও চিহ্নিত করে দিয়েছে। এই দিনে প্রত্যাশা এই যে বাংলাদেশের সমবায়ীরা ভয়ভীতি এড়িয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও তৃণমূলকরণের দাবি জানাবেন। সমবায়-কৌশল প্রয়োগের ভাবনাটি শুরু করবেন।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি। গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।