ঈদ ও বন্যায় বাড়তি ঝুঁকি

বাংলাদেশের সব অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ যখন আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তখন নতুন করে বড় দুটি ঝুঁকি সামনে এসেছে। একটি আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা, অন্যটি বন্যা। কোরবানির পশু কেনাকাটা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। পশুর হাটের যেসব ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে, সেগুলো উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাবেক মহাপরিচালক সংবাদমাধ্যমে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন—গত ঈদুল ফিতরের পরপর সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। আসন্ন ঈদুল আজহার সময়েও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা তো বটেই, আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও এখন আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, জনপরিসরে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে সংক্রমণ আরও বাড়তেই থাকবে।

ওদিকে দেশের ১২টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার ফলেও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে। কারণ, বন্যাদুর্গত মানুষের পক্ষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন। ঘরবাড়ি আরও প্লাবিত হলে অনেক মানুষকে একসঙ্গে আশ্রয় নিতে হয় উঁচু সড়ক, বাঁধ, স্কুলঘর ইত্যাদি জায়গায়; দিনরাত কাটাতে হয় গাদাগাদি করে। এ রকম ঘনবদ্ধ বসবাস ভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির অনুকূল। বন্যার ঢল ঠেকানো সম্ভব নয় বটে, তবে বন্যাদুর্গত মানুষকে করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই—এটা মনে করারও কোনো সুযোগ নেই। মানুষকে বাঁচাতে হবে, সে জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যকর পন্থাগুলো খুঁজে পেতে হবে।

দুটো পরিস্থিতি দুই রকমের হলেও সমস্যাটা অভিন্ন—মানুষের সঙ্গে মানুষের শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জীবনযাপনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটানো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যরা ১ জুলাই একটি সভায় কোরবানির ঈদের সময় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনসাধারণের করণীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। ওই কমিটি সরকারের জন্য কিছু পরামর্শ তৈরি করেছে। যেমন কোরবানির ঈদের আগের ও পরের তিন দিন গণপরিবহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে লোকজন ঈদ করতে দলে দলে শহর থেকে গ্রামে যেতে না পারে। পশুর হাটগুলোতে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, গত ঈদুল ফিতরের আগেও বলা হয়েছিল, যিনি যে স্থানে অবস্থান করছেন, তিনি সেখানেই ঈদ উদ্‌যাপন করবেন, অন্যত্র যেতে পারবেন না। কিন্তু সরকারের এ আদেশ বা পরামর্শ তেমন মানা হয়নি। গত ঈদের পরে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল এটাই যে ঈদের ছুটিতে প্রচুর মানুষ চলাচল করেছে, অধিক সংক্রমিত শহরগুলো থেকে গ্রামে গেছে এবং গ্রামেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এবারের বাড়তি ঝুঁকি হলো কোরবানির পশুর হাট। এগুলোতে ভিড় এড়াতে অবশ্যই বাড়তি নজরদারির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনলাইনে পশু কেনাবেচা বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত।

সমস্যা হলো পর্যবেক্ষক বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ-পরামর্শ সরকারের দরবারে পেশ করেন, নীতিনির্ধারকেরা সভায় বসে যেসব সিদ্ধান্ত নেন, সেগুলো ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়নের রেকর্ড হতাশাব্যঞ্জক। এ পর্যন্ত যেসব করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যেসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করা হলে সংক্রমণ পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটত না। রেড জোনগুলোতে লকডাউন বাস্তবায়ন নিয়ে যে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা–ও দ্রুত দূর করতে হবে। কোনোভাবেই সময় নষ্ট না করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও নীতিনির্ধারকদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো আন্তরিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। প্রত্যেককে অর্পিত দায়িত্বের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি প্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় সরকারকাঠামো, নাগরিক-সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি, পরিবার—সবার মিলিত প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি।