কুর্দি সংগ্রাম কি হারিয়ে গেল?

কুর্দিদের একসময়ের শত্রু আমেরিকা এখন বন্ধু
কুর্দিদের একসময়ের শত্রু আমেরিকা এখন বন্ধু

মধ্যপ্রাচ্যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের নামে প্রায় ছয় দশক ধরে কুর্দিদের সংগ্রামকে পশ্চিমারা প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি। সোভিয়েত–উত্তর যুগে ধীরে ধীরে কুর্দিরা পশ্চিমাদের নজরে আসতে শুরু করে। ইরাকি কুর্দিদের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক আলাপ ইরাক যুদ্ধের সময়। ঠিক একইভাবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মারপ্যাঁচ কুর্দি স্বাধীনতাসংগ্রামী দল পিকেকেকে মার্কিনদের সঙ্গী করেছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পশ্চিমা গণমাধ্যমের ও রাষ্ট্রীয় সমর্থন আদায় করে নিয়েছিল কুর্দিদের সংগ্রাম। তবে বিনা মূল্যে কিংবা মানবতার খাতিরে মেলেনি এই পশ্চিমা সহায়তা। পশ্চিমা সামরিক সহায়তা এবং বন্ধুত্বের জন্য দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের আদর্শিক আন্দোলনকে নির্বাসন দিতে হয়েছে পিকেকেকে। পিকেকের এই আদর্শিক বদল মেনে নিতে পারেনি কুর্দিদের একটি অংশসহ আরব ও পশ্চিমা প্রগতিশীলরা।

একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম শুরু হয়েছিল অটোমানদের শেষ সময়ে। কিন্তু অটোমানদের সঙ্গে ধর্মীয় বন্ধনের দরুন এই আন্দোলন বেগবান হয়নি। তাই আরবদের সহায়তায় ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মধ্যপ্রাচ্য দখলে নিলেও কুর্দিদের ভরসাস্থল ছিল অটোমানরা। ফলে, পশ্চিমা পরিকল্পনা অনুসারে সাইকস-পাইকট চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে আরবরা মোটাদাগে প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র পেলেও কুর্দিদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল ইরাক, ইরান, সিরিয়া আর তুরস্কের মধ্যে। কুর্দিরা এই বিভক্তি মেনে নেয়নি। নিজস্ব মাতৃভূমির জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং ইরানে ১৯৪১ সালে প্রথম মাহাবাত প্রজাতন্ত্র নামে প্রথম কুর্দি রাষ্ট্র গঠন করে। সোভিয়েত সহায়তায় গঠিত এই রাষ্ট্রের আয়ু ছিল এক বছরেরও কম।

মোটাদাগে তখন থেকেই আরব ও তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা পশ্চিমা ধাঁচের জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে কুর্দিদের ওপর সব রাষ্ট্রীয় কলকবজা ব্যবহার করে অত্যাচার শুরু করে। তুরস্কের রাষ্ট্রনায়ক মুস্তাফা কামাল পাশা হাজার হাজার কুর্দি আলেমকে হত্যা করে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন অটোমান এবং কুর্দিদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায়। কুর্দি ভাষাকে নিষিদ্ধের পাশাপাশি পাবলিক পরিসর থেকে নিষিদ্ধ করেছিলেন কুর্দিদের জাতীয় পোশাক। ফ্যাসিবাদী এই নীতির বিরোধীদের জায়গা হয়েছিল কারাগারে অথবা অথবা ফাঁসিকাষ্ঠে, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ সাইদ। ১৯২৫ সালে দিয়ারবাকেরে জনসমক্ষে শেখ সাইদকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় মুস্তফা কামালের বিরুদ্ধাচরণের দরুন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দরুন ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের রাসায়নিক অস্ত্রের বলি হতে হয়েছিল কুর্দিদের। সিরিয়ায় ২০১১ সালের আগপর্যন্ত কুর্দিদের আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব ছিল না।

এই নিদারুণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে গত শতাব্দী থেকে আন্দোলন–সংগ্রামে লিপ্ত কুর্দিরা। ইরাক ও তুরস্কের কুর্দিরা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। ইরাকি কুর্দিরা বারযানি পরিবারের নেতৃত্বে ধর্মকে সঙ্গেই নিয়ে আন্দোলনে নামে। তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দিদের একটি অংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে সমাজবাদী চিন্তার সংস্পর্শে আসে। সমাজবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্তরের দশকের শেষ দিকে আবদুল্লাহ ওযালানের নেতৃত্বে গঠন হয় পিকেকে। গেরিলা সব আক্রমণ দিয়ে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের লাগাম টেনে ধরেছিল পিকেকে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ সময়ে সারা দুনিয়া থেকে অনেক সমাজবাদী চিন্তার ভক্ত পিকেকেকে নিজেদের ভবিষ্যৎ বানিয়ে নিয়েছিলেন।

মোটাদাগে, ২০০০ সাল পর্যন্ত কুর্দিদের এই আন্দোলন বারযানি পরিবার এবং পিকেকের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শিক অবস্থান নিয়ে আটকে ছিল। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০০৩ সালের মার্কিনদের ইরাক আগ্রাসনে মিত্র হওয়ার দরুন ইরাকের কুর্দিরা বারযানি পরিবারের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। আর ইরাক যুদ্ধপরবর্তী সময় তুরস্কে এরদোয়ানের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে নতুন এক যুগের শুরু হয় এবং ২০০৯ সালে পিকেকের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৩ সালে উভয় পক্ষ—তুরস্ক সরকার ও পিকেকে—আপসের ভিত্তিতে সব ধরনের সন্ত্রাসের ব্যবহারকে বিদায় দিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শান্তি চুক্তিতে উপনীত হয়। দিয়ারবাকিরে কুর্দিদের বার্ষিক উৎসব নেভরোজ থেকে এই চুক্তি ঘোষিত হয়।

তবে সবকিছু বদলে দিয়েছিল আইএসআইয়ের উত্থান এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। পশ্চিমা গণমাধ্যমের কল্যাণে আইএস সম্পর্কে একটি সরল একরৈখিক পঠন তৈরি হয়েছে; আইএসআই আল–কায়দার পরিপূরক। কিন্তু এই একরৈখিক পঠন মানতে আগ্রহী না বিশ্লেষকেরা। তাঁদের প্রশ্ন, ইরাকে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিতে আইএসের উদ্ভব কীভাবে হলো এবং কীভাবে রকেটের গতিতে আইএস সিরিয়া ও ইরাকের একটি বৃহৎ অংশ দখল করে নিল? যাঁরা আঞ্চলিক রাজনীতির নাড়ি-নক্ষত্র জানেন, তাঁরা আইএসের উত্থানের পেছনে মার্কিনদের ভূমিকা দেখতে পান। শুরুতে আইএস দমনে তুরস্কের সেনা বাহিনী প্রেরণের পশ্চিমা প্রস্তাবকে সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি আঙ্কারা। মূলত, তালেবান দমনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেহাল অবস্থা টের পেয়ে আঙ্কারা এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ইরাক ও আফগানিস্থানের সম্মুখযুদ্ধে প্রায় সাত হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে পশ্চিমা সামরিক বিশারদেরা আইএসের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে না গিয়ে বরং আঞ্চলিক কোনো শক্তিকে আইএসের মুখোমুখি করতে চেয়েছিল।

২০১৫ সালে ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পিকেকে প্রকাশ্যে মার্কিনদের সঙ্গী হয়। তুরস্কের সঙ্গে শান্তি চুক্তি বাতিল করে পিকেকে নাম বদল করে মার্কিনদের দলে ভিড়ে যায়। পশ্চিমা গণমাধ্যম এই পরিবর্তনকে কুর্দি বসন্ত বলে অবহিত করেছিল। মার্কিনরা ১৯৯৯ সালে পিকেকেকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে মার্কিন স্পেশাল কমান্ডার জেনারেল রেয়মনড থমাস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন কীভাবে তিনি পিকেকের সিরিয়া শাখা ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টিকে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সে রূপান্তরিত করেন। পশ্চিমে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য কমান্ডার জেনারেল রেয়মনড থমাস নামের সঙ্গে ‘ডেমোক্রেটিক’ নামটি যুক্ত করে দিয়েছিলেন; যার বর্ণনা তাঁর নিজের জবানেই বর্ণিত হয়েছে। নতুন এই সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের জন্য মার্কিনদের ২০১৯ সালে বরাদ্দ ছিল ৫৫৫ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৩০০ মিলিয়ন এবং ২০২১ সালের প্রস্তাবিত বাজেট ২০০ মিলিয়ন ডলার।

মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইউরোপের সমাজবাদী চিন্তকেরা পিকেকের এই আদর্শিক বদলে বেজায় অসন্তুষ্ট। স্নায়ুযুদ্ধকালে মধ্যপ্রাচ্যে সমাজতন্ত্রকে রুখে দেওয়ার নামে পশ্চিমারা পিকেকে দমনের জন্য তুরস্ক এবং সাদ্দাম হোসেনকে বিশাল অর্থ এবং সামরিক সাহায্য প্রদান করেছিল। পশ্চিমাদের সেই অর্থ এবং বন্দুকের বলি হয়েছিল ইরাক ও তুরস্কের হাজার হাজার সাধারণ কুর্দি। এমনকি ১৯৯৯ সালের পিকেকের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ ওযালানকে কেনিয়া থেকে মার্কিনরা গ্রেপ্তার করে তুরস্কের হাতে তুলে দিয়েছিল। ইয়াসির আরাফাতের মতোই ওযালান মধ্যপ্রাচ্যে সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের মধ্যেই মুক্তি দেখতে পেয়েছিলেন। ওযালানের প্রতিষ্ঠিত সেই গেরিলা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এখন মার্কিনদের হাতে।

সর্বশেষ আঙ্কারার ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যকার চুক্তির দরুন ইয়েপেগে তুরস্কের সীমানা থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে হস্তান্তরিত হয়েছে। তুরস্ক ও আরব বিশ্বের সমাজবাদী চিন্তকেরা এই পরিবর্তন মানতে পারছেন না। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না যে হাজার হাজার তরুণী–তরুণ সমাজবাদের আদর্শে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করেছিল, সেই বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ এখন মার্কিনদের হাতে। মার্কিনদের অর্থসাহায্য নিয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য সিরিয়ার তেলকূপগুলো পাহারা দিচ্ছে তারা। ট্রাম্প তাঁর টুইটে সেই কথা বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছেন। সর্বশেষ মার্কিনদের মধ্যস্থতায় ইয়েপেগে ও পিকেকে মিত্র হয়েছে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে। নিয়মিত অর্থ ও সামরিক সাহায্য নিচ্ছে সৌদিবলয় থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আসন্ন ইরান যুদ্ধে সৌদিরা মার্কিনদের প্রশিক্ষণের দরুন পেশাদার হয়ে ওঠা ইয়েপেগের এবং পিকেকের ৫০ থেকে ৬০ হাজার সৈন্যকে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতি গণমানুষের ক্রোধকে ব্যবহার করে মার্কিনরা অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ফায়দা লুটতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সাদ্দাম ও আসাদের নৃশংসতাকে কাজে লাগিয়ে যেভাবে ইরাক ও সিরিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদকে কবজা করেছে, ঠিক একই পদ্ধতিতে কুর্দিদের বিশেষ করে পিকেকের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্পৃহাকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের সমাজবাদী চিন্তাচেতনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন কুর্দির জন্য হয়তো মার্কিনরা পিকেকে ও বারযানি পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা দুটি রাষ্ট্র গঠন করে দেবে, কিন্তু সেই রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে, আদর্শিক অবস্থানে এবং সমাজকাঠামোর প্রপঞ্চগুলো পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভবিষ্যতে ইতিহাস পিকেকেকে মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

রাহুল আনজুম: গবেষক