ওয়াহিদুল হকের হৃদয়জুড়ে ছিল স্বদেশ

সাবেক অর্থমন্ত্রী ওয়াহিদুল হক
সাবেক অর্থমন্ত্রী ওয়াহিদুল হক

তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল বাংলাদেশ। ভালোবাসতেন এ মৃত্তিকা। পাকিস্তানি স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান কলকাতায়। দিল্লি গিয়ে ওঠেন বন্ধু অশোক মিত্র আর অমর্ত্য সেনের বাড়ি বাদল হালদার ছদ্মনামে। মুক্তিযুদ্ধে রাখেন অসাধারণ ভূমিকা।

বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল করতে আশির দশকের শেষ দিকে বিদেশ থেকে এসে হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। রূঢ় সত্যি কথা বলে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল। চেয়েছিলেন বিদেশে অর্থ পাচার ঠেকাতে। আমজনতার স্বার্থে বাজেট দিতে। ১৯৯০ সালের মে মাসে জাতীয় বাজেট ঘোষণার দিন কয়েক আগে পদত্যাগ করে তাঁকে আবার টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনায় ফিরে যেতে হয়েছিল।

বলছি কিংবদন্তি অর্থনীতিবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ওয়াহিদুল হকের কথা। ৩ জুলাই কানাডার টরন্টোয় ইন্তেকাল করেছেন এই ভুবনবিখ্যাত গাণিতিক অর্থনীতিবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে মাস্টার্স শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যান ১৯৫৯ সালে পিএইচডি করতে। ডিগ্রি অর্জন করে ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে ও টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। পরিসংখ্যান তাঁর অতি প্রিয় বিষয়।

অর্থনীতিতে জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম থিওরির ওপর রয়েছে তাঁর জগদ্বিখ্যাত হাইপোথিসিস। মনে পড়ে তিনি যখন অর্থমন্ত্রী, তখন অধুনালুপ্ত বাংলাদেশ অবজারভার–এর অর্থনৈতিক রিপোর্টার প্রয়াত মোয়াজ্জেম হোসেন খসরু ভাই, নিউ নেশন–এর হাসান আবুল কাশেম ও দৈনিক সংবাদ–এর আমি নিয়মিত তাঁর দপ্তরে একসঙ্গে যেতাম। অসম্ভব মেধাবী এই পণ্ডিত তাঁর অর্থনৈতিক ভাবনা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। আমাদের মতামত জানতে চাইতেন।

বৈষম্য কমিয়ে কী করে সমতা আনা যায়, কলকারখানার উৎপাদন বাড়ানো যায়, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি আর কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায়, অর্থ পাচার ঠেকানো যায়, কর রাজস্ব সংস্কার ভ্যাট প্রচলন কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে তাঁর ভাবনার কথা বলতেন।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বৈরাচারী এরশাদ তাঁর সে জনমনস্ক ভাবনা আমলে নেননি। বরং অর্থ পাচার নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলার কারণে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিন কয়েক আগে তাঁকে পদত্যাগ করতে হলো। বিদেশে অর্থ পাচারকারী চক্র সে সময় ও কত শক্তিশালী ছিল। দেশপ্রেমিক এই পরিশুদ্ধ পণ্ডিত ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে গেলেন আবার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষক এই ভুবনবিখ্যাত গাণিতিক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হক বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৬৯ সালে আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বঞ্চনা নিয়ে তথ্য–উপাত্ত পরিসংখ্যান দিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করতেন। আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, প্রয়াত অধ্যাপক ওয়াহিদুল হক ও অধ্যাপক মুশাররফ হোসেইন, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক রেহমান সোবহানের রয়েছে অসামান্য অবদান।

তিনি ছিলেন দূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। বাংলাদেশে ভ্যাট প্রচলনের কথা ড. হক চিন্তা করেছিলেন ১৯৮৮-৮৯ সালে। আরও কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারকাজ তিনি হাতে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রয়াত মন্ত্রী সাইফুর রহমান ভ্যাট চালু করেন, সংস্কারকাজ শুরু করেন।

ড. হকের দুর্ভাগ্য তিনি বড় অসময়ে অর্থমন্ত্রী হন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের মে পর্যন্ত তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী।

বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁর দেওয়ার ছিল অনেক। কিন্তু এ দেশের কাজে তাঁকে গেল ৩০ বছর কেউ ডাকেনি। এ নিয়ে তাঁর ছিল আক্ষেপ। ড. হকের বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। সেই আক্ষেপ নিয়েই পরিণত বয়সে তিনি মায়াভরা পৃথিবী ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে গেলেন। আল্লাহ স্যারকে বেহেশত নসিব করুন। অতল শ্রদ্ধা।

*কামরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব এবং জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক রিপোর্টার