মহামারির ব্যাকরণ ও আমাদের ভাষা

করোনাভাইরাস ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: রয়টার্স

সংক্রামক রোগ জন থেকে জনে ছড়িয়ে জনসমুদ্রকে আক্রান্ত করলে মহামারি হয়। একজন আক্রান্ত মানুষ সব মিলে কতজন মানুষকে সংক্রমিত করে, সেটাই মহামারি বিস্তৃতির গতি ও পরিধির পরিমাপ, যাকে সংক্রমণের সংখ্যাবৃদ্ধির হার বা R০ (Reproduction Number) বলে। একজন মাত্র একজনকেই আক্রান্ত করলে R০ হয় ১। R০ বড় হতে থাকলে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে এবং মহামারিও তত বড় হতে থাকে, বহু স্থানে ছড়ায় এবং দ্রুত চূড়ায় উঠতে থাকে। এমন অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ দুরূহ। 

মহামারির আকার, আকৃতি, গতি ও প্রকৃতি নিত্যপরিবর্তনশীল। ফলে সংক্রমণের ধারা নজরে রাখতে পারাটাই সাফল্য। নজরে রাখার সুযোগ হারালে নীরবে ও অদৃশ্যভাবে সংক্রমণ চলতে থাকে এবং R০ ১–এর ওপরে উঠতে থাকে। জীবনযাত্রা ও কর্মচাঞ্চল্যকে অব্যাহত রেখে মহামারিকে নজরে রাখার ও R০ কমানোর প্রধান ও টেকসই উপায় সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে টেস্ট করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা, ট্রেসিং করে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং ব্যক্তিকে যথাক্রমে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন করা।

সংক্রমণের সূচনাপর্বে রোগীর সংখ্যা সীমিত থাকায় শুধু টেস্ট ও ট্রেসিং করেই R০ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এভাবে সংক্রমণ আটকে দেওয়া গেলে প্রাণ ও সম্পদ এবং জনজীবন ও জীবিকার ন্যূনতম ক্ষতির বিনিময়ে মহামারি অঙ্কুরে বিনাশ করা সম্ভব।

তবে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকলে বহু সংখ্যায় টেস্ট ও ট্রেসিং এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন ক্রমে দুরূহ হয়ে পড়ে। সংক্রমণ কিছু এলাকার মধ্যে সীমিত থাকলে ব্যক্তির বদলে একটি জনগুচ্ছকে আলাদা বা লকডাউন করে বিচ্ছিন্ন করা গেলে সংক্রমণের পরিধি জনগুচ্ছের মধ্যে সীমিত হয় এবং এলাকায় R০ কমে আসে। তবে ছড়িয়ে পড়া স্থানের সংখ্যা বহু হলে একেক সময়ে একেক এলাকায় লকডাউন দিলে তা টেকসই করে R০ কমাতে কার্যকর হওয়ার নয়।

সংক্রমণ সামাজিক পরিধিতে ছড়ালে R০ ক্রমে উর্ধ্বগতিসম্পন্ন হয় এবং তার নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়। টেস্ট–ট্রেসিং এবং আইসোলেশন–কোয়ারেন্টিনের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক লকডাউনও আর প্রাসঙ্গিক, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর থাকে না। এ সময় সামগ্রিক বা দেশ বা প্রদেশব্যাপী লকডাউন জরুরি হয়ে পড়ে। তবে আঞ্চলিক আর সামগ্রিক লকডাউন কোনোটিই মহামারি নিয়ন্ত্রণে অনুপম, একমাত্র ও শেষ পদ্ধতি নয়, একটি ধাপমাত্র। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যেকোনো উপায়ে হোক R০–কে টেকসই নিয়ন্ত্রণে নিতেই হবে। বাস্তবসম্মত পরবর্তী ধাপে তা সুসংহত করতে হয়।

আমাদের ভাষা
মহামারি নিয়ন্ত্রণে নাকাল হয়ে সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করা হয়। শনাক্ত ৩৩ জন পরবর্তী কয়েক দিনে ৫০ জনে উত্তীর্ণ ও ৪৫ জন সুস্থ হলে তিন সপ্তাহে লকডাউনে ফলাফল পাওয়া গেছে বলে অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা এল।

ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

এলাকাটি সত্যিই সংক্রমণমুক্ত হলে বাসিন্দাদের নিজেদের সংক্রমিত হওয়া ও অন্যদের সংক্রমিত করার আশঙ্কা এখন শূন্য। এলাকাটি রোগ ছড়ানোর উৎস হলেও আপাতত তা বিনাশ হয়েছে। তবে আক্রান্ত ৫০ জনের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের না করা এবং শুধু উপশমে আক্রান্ত ও আগ্রহী ব্যক্তিদের পরীক্ষা করার কারণে তার নিশ্চয়তাও কম। অন্যদিকে এলাকাবাসীর সংক্রমণের সূত্র এলাকার বাইরে হলে লকডাউন উঠে যাওয়ায় আবারও ঝুঁকি বাড়ল। সবুজ থেকে লাল এখন সময়ের ব্যাপার। তাহলে ফলটি কী? রোগী সুস্থ হওয়া? তা তো টেস্ট-ট্রেসিং ও জন পঞ্চাশেক মানুষকে আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিন করেও সম্ভব ছিল, ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে অযথা আটক করে কর্মচাঞ্চল্য থমকে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই ফল না এলাকার জন্য টেকসই, না অন্য এলাকায় দীর্ঘকালীন কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মাঝখান থেকে জনতুষ্টির লক্ষ্যে মশা মারতে কামান দাগায় ফসকে গেল শেখার জায়গাটি।

নতুন করে বোঝা
তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়। যদিও সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা হয়নি; দৃশ্যত প্রথমে শনাক্ত ৩৩ জনের সংখ্যা পরবর্তী ২১ দিনে দ্বিগুণ হয়নি বলে ধরে নেওয়া যায় যে আইসোলেশনে ঘরে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা ও মাত্রা বিপজ্জনক নয়।

এখান থেকে একটি সম্ভাবনা যাচাই করা যায় যে দেশব্যাপী সর্বাত্মক ও স্বল্পকালীন লকডাউনে এ ধরনের কার্যত শূন্য R০–এর সুফল পরে স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য নানা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের মাধ্যমে মুক্ত সমাজে স্থানবদল ও টেকসই করা যায় কি না? এ ব্যাপারে কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সামগ্রিক লকডাউন বা আইসোলেশনের মাধ্যমে অর্জিত সামগ্রিক কার্যত শূন্য R০ অবস্থাকালে, ব্যাপক র‍্যাপিড টেস্ট সম্পাদনের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিমুক্ত ব্যক্তিদের জনে জনে বাছাই করে দ্রুততম সময়ে কর্মক্ষেত্র ও মুক্ত সমাজকে নিরাপদ করার একটি সহজ, বিজ্ঞান ও বাস্তবসম্মত কৌশলও রয়েছে।

অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের র‍্যাপিড টেস্টের কার্যকারিতা নানা দেশে ৯০ শতাংশের ওপর দাবি করা হলেও দেশে তৈরি একটি কিটের কার্যকারিতা যথাক্রমে ৩০ ও ৭০ শতাংশে পাওয়া গেছে। সহজসাধ্য ও ব্যয়বহুল না হওয়ায় ব্যাপকভাবে এই টেস্ট করে অধিকসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনা যায়। প্রচলিত পিসিআর টেস্ট ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় টেস্টের সংখ্যা দীর্ঘদিন ধরে রোজ ২০ হাজার পর্যন্ত উত্তীর্ণ করা যায়নি। টেস্ট করতে ও ফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে অনেক মানুষ পরীক্ষার আওতার বাইরে থেকে রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধ গ্রহণ থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হচ্ছেন।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় এদের সংখ্যাও বাড়ছে। টেস্টের নজর এড়িয়ে উপশমহীন থেকে এরা নীরবে R০ ও মহামারির শক্তি ও ব্যাপ্তি বাড়িয়েই চলেছে। টেস্ট ও ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে এদের নজরদারিতে আনা না গেলে শুধু লকডাউন দিয়ে সাময়িক সংক্রমণ কমিয়ে মহামারির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে না। এখন প্রয়োজন টেস্টের এক মহাযজ্ঞ। পিসিআর দিয়ে এই মহাযজ্ঞ অসম্ভব।

জানা যায় যে আরটি পিসিআর গবেষণার কাজে যত দক্ষ ও কার্যকর (৯৬%), রোগ নির্ণয়ে তা নয় (৬০%)। নানা কারণে এই পার্থক্য ঘটে। নাক ও গলা থেকে নেওয়া নমুনায় এই হার গড়ে ৬০ শতাংশ বা আরও কম হতে পারে। দিনে দিনে পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়লেও মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় তা আদতে কতটা, তাও অজানা।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ফলে পিসিআরের ওপর অতিনির্ভরতা ও টেস্টস্বল্পতা প্রকৃত পরিস্থিতি আড়াল ও আইসোলেশন বিলম্বিত করে এবং R০ বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিগ্রস্ত করতেও সক্ষম। বাস্তবে কী ঘটছে, তা আমাদের অজানা। তবে ১০০ জনকে পিসিআর পরীক্ষার দিয়ে যদি ৬০ জনকে শনাক্ত করা যায়, সে ক্ষেত্রে ২০০ জনকে র‍্যাপিড টেস্ট করা হলে একই হারে রোগী শনাক্ত করা সম্ভব, যদিও তা শতকরা ৩০ ভাগ কার্যকর হয়। এতে ব্যয় সাশ্রয় হয় অন্তত ১০ গুণ এবং সময় বাঁচে গড়ে ৭ দিন। পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল পেতে ১০ দিনও লাগে।

বিষয়টি নিশ্চিত যে R০ কমানো না গেলে এলোপাতাড়ি কর্মযজ্ঞে মহামারি দমন হবে না। দ্রুত তা কমাতে হলে পর্যাপ্ত টেস্ট, ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন করা অপরিহার্য। ধীরগতি পিসিআর কৌশল দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ও দ্রুত মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে অন্যভাবে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো গেলে তা সম্ভব। প্রতি ১০০ জন আরটি পিসিআর পরীক্ষার বদলে ৪০০ জনকে র‍্যাপিড টেস্ট করা হলে এখনই শনাক্তের হার দ্বিগুণ করা ও R০ দ্বিগুণ গতিতে কমানো যায়। যেমন বর্তমান R০ (১.৫) এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি ১০০টি পিসিআর যেখানে ৯০ জনকে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে, ৪০০টি র‍্যাপিড টেস্ট বাঁচায় ১৮০ জনকে।

অবসানের পথে ফেরা
মহামারির প্রেক্ষাপটে টেস্টের টেস্ট বা পারদর্শিতা যাচাই নয়, কজনকে সংক্রমণ থেকে বাঁচানো যায়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই কৌশল। র‍্যাপিড টেস্টকে বহুমাত্রিক মূল্যায়ন করা না হলে একে অবজ্ঞা করা হবে, মাশুল হতে পারে কড়া। এতে বারবার লকডাউন এড়ানো যায়, নজর হারানো মহামারিকে আবারও নজরদারিতে ফিরিয়ে আনা যায়, জীবনকে সুরক্ষা দেওয়া যায়, সমাজজীবনকে কর্মচঞ্চল করা যায় এবং জীবিকা ও অর্থনীতিকে কশাঘাতমুক্ত করা যায়। প্রয়োজন বাস্তবতা ও কৌশলগত বিবেচনায় বিতর্ক শেষ করা এবং জ্ঞানভিত্তিক সতর্ক কৌশল নেওয়া।

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম: সার্জন ও পেশেন্ট সেফটি বিশেষজ্ঞ, সাবেক ডিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়